দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া বিলের পরিমাণ ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ২৪ হাজার কোটি টাকা) ছাড়িয়েছে। বকেয়া এ বিল পরিশোধের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে প্রতি সপ্তাহে ১৬ কোটি ডলার অর্থছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী অর্থছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম উইওনে প্রকাশিত এক সংবাদেও বলা হয়েছে, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, এলএনজি সরবরাহকারী এবং আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোর (আইওসি) পাওনা পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে ৯৬০ মিলিয়ন বা ৯৬ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য ১৬ কোটি বা ১৬০ মিলিয়ন ডলার এবং এলএনজি সরবরাহকারী এবং আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির জন্য সপ্তাহে ৮০ লাখ বা ৮ মিলিয়ন ডলার অর্থছাড় করা হবে।
দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও আইওসির বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটির বরাতে উঠে এসেছে। তবে বিষয়টি জানতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বকেয়া বিল পরিশোধের উদ্যোগ এরই মধ্যে দেখা গেছে। ভারতের বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের কয়েক মাস আগের ১৭ মিলিয়ন বকেয়া পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। ২৫ ও ২৬ জুলাই দুই কিস্তিতে এ অর্থ পরিশোধ করে সংস্থাটি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিল পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে উইওনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদ্যুতের সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে চায় সরকার। এজন্য বৈশ্বিক ঋণদাতাদের সমর্থনে জ্বালানির এ বিল পরিশোধের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আর্থিক সংকট কাটাতে এরই মধ্যে ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছ থেকে প্রায় ৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে জোরালো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের বরাত দিয়ে নয়াদিল্লিভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎ মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিল বাবদ ৪৭৫ মিলিয়ন এবং আইওসি ও স্থানীয় গ্যাস কোম্পানিগুলোর কাছে ৩৫০ মিলিয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট থেকে এলএনজি আমদানি বাবদ সরবরাহকারীদের কাছে ৩২০ মিলিয়ন বকেয়া পড়েছে। বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিলের মধ্যেই সরকার সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে অর্থনৈতিক ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পিএসসি (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ মূলত বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
এদিকে বকেয়া বিল পরিশোধে বিপিডিবির অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। দিন দিন আরো কঠিন হয়ে পড়ছে আইপিপি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখা। যদিও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
দেশে প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের তীব্র সংকট। ব্যাংকগুলো তাই আমদানির ঋণপত্র (এলসি) দায় ও বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি দায় পরিশোধের জন্য রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়েছে। গত জুলাইয়েও বিক্রির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত দেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমছে। গত ২৬ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী (বিপিএম৬) এর পরিমাণ আরো অনেক কম, ২৩ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আমদানিতে বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যয় হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, এ খাতের জন্য প্রতি মাসে বাড়তি ডলার পরিশোধ করতে হলে রিজার্ভের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক অবশ্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিনই ৬-৭ কোটি ডলার বিক্রি করছে। এর ৭৫ শতাংশই যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এখন প্রতি মাসে সরকার যদি ৯৬ কোটি ডলার দিতে বলে, সেটির সংস্থান করা দুঃসাধ্য হবে না।’