আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে দেশে বৈষম্য আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল সিপিডি ও নাগরিক প্লাটফর্ম আয়োজিত এক সংলাপে তারা এ আশঙ্কার কথা জানান। ‘আইএমএফের
সময়ে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের কথা: জাতীয় বাজেট কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে’ শীর্ষক এ সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বিভিন্ন বিষয় সামনে এনে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশে
আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্য বেড়েছে। এ বৈষম্যের ঊর্ধ্বমুখিতা গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। এমন একটি পরিস্থিতিতে আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে বৈষম্য আরো বাড়বে। আমি মনে করি, আইএমএফের ঋণ নেয়ায় বাজেট অনাথ হয়ে গেছে, যেখানে আইএমএফ হলো পালক পিতা। এমন মনে করার কারণ হলো, এখন পর্যন্ত যতগুলো দেশ আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সব দেশেই বৈষম্য বেড়েছে বৈ কমেনি।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাজেটের
২২ শতাংশই ভৌত অবকাঠামোয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেখানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রথম আট-নয়টি অবকাঠামোকেন্দ্রিক প্রকল্প। ফলে তৈরি হচ্ছে খাতওয়ারি বৈষম্য। কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া সুদহার বৃদ্ধি সঠিকভাবে না হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নেতিবাচক ধাক্কা লাগবে।’ আসন্ন বাজেটে গুরুত্ব আরোপের জন্য কিছু পরামর্শও দেন এ অর্থনীতিবিদ।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বাজেট তৈরিতে সরকার আইএমএফের ওপর নির্ভরশীল নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের
বাজেট আমরাই তৈরি করছি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের বাজেটে ২ শতাংশেরও কম দাতাদের কাছ থেকে নেয়া হয়। বরং বাজেটের প্রয়োজনে আমরা ঋণ নিই।’ পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের
যে রিজার্ভ আছে সেটি দিয়ে চার-পাঁচ মাস চলবে। সেজন্য এ রিজার্ভ দুশ্চিন্তা হওয়ার মতো কিছু নয় বলে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যরাও উল্লেখ করেছে। এছাড়া আমাদের মূল্যস্ফীতি খুব সামান্য কমেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মজুরি।’
অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আইএমএফ
অন্যান্য ব্যাংকের মতো একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক। অন্যান্য ব্যাংকের মতো তারাও লোনটা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তাই সে লক্ষ্যে তারা শর্তারোপ করেছে। এতে কিছু অসুবিধা থাকবে। তার প্রভাব পড়বে প্রান্তিক জনগণের ওপর। এর পাশাপাশি জিডিপিতে করের হার বাড়ানোর উপায়টি জটিল বলে মনে করি আমি।’
বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘সরকার
বলছে রিজার্ভ সংকট নেই। কিন্তু এ সংকটের জন্য আমরা জ্বালানি আমদানি করতে পারছি না। বর্তমানে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে টাকা নেই আমাদের। মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। এ বিষয়ে সানেমের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাত খাওয়া কমিয়েছে ৩৭ শতাংশ মানুষ, মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ, মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ এবং ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ। বাজেটের আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্বাচনের আগে বছর প্রচুর টাকা পাচার হয়ে যায়। ২০১৪ সালে সে পরিমাণটি ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ রাষ্ট্রে এখন লুটপাটতন্ত্র চলছে।’
সংলাপে বিশেষ বক্তা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্? বলেন, ‘বাজেটের
কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের অনেক অঞ্চল আছে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ। সেই অঞ্চলগুলোর জন্য সমানভাবে বাজেট বরাদ্দ করা দরকার। এছাড়া আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন অল্প অর্থনৈতিক ধাক্কায় সংকটে পড়ে যায়। বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের এখানে অসংখ্য অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র আছে। সেই মানুষগুলো চাঁদা দিয়ে টিকে আছে। তাদের স্বীকৃতি দিলে আমাদের ট্যাক্সও বাড়বে। বর্তমানে চিকিত্সার ৭২ শতাংশ যায় নিজের পকেট থেকে। তাই স্বাস্থ্য খাতে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বশেষ একটি বিষয়ে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে—নন-স্টেট অ্যাক্টরগুলোকে কৌশলগত অংশীদারত্বে যুক্ত করা।’