দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১১ হাজার ৩৭২ মেগাওয়াট (২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত)। বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদার মৌসুমে গ্যাসভিত্তিক এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বর্তমানে দৈনিক সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে। বাকি প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এখন উৎপাদন বন্ধ। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় একটি অংশ বসে আছে গ্যাস সংকটের কারণে। সংস্কার ও মেরামত কার্যক্রম চলায় উৎপাদন হচ্ছে না কয়েকটিতে। বাকিগুলো বসে আছে পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে।
তীব্র গরম ও তাপদাহের কারণে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে লোডশেডিংও। জ্বালানি সংকটে উৎপাদন বন্ধ রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে লোডশেডিং অনেকটাই কমিয়ে আনা যেত বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর স্থাপিত সক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ১১ হাজার ৩৭২ মেগাওয়াট, যা মোট সক্ষমতার ৪৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ২ হাজার ২০০ এমএমসিএফডি (মিলিয়ন ঘনফুট/দৈনিক)। এর মধ্যে এখন সরবরাহ হচ্ছে অর্ধেকের সামান্য বেশি—১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফডি।
এর মধ্যে তীব্র তাপদাহে গতকাল ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করা হয়েছে। বিপিডিবি জানিয়েছে, গতকাল দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট। যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি ছিল গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে মোট সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই এখন গ্যাসনির্ভর। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস উত্তোলন এখনো যথাযথ মাত্রায় বাড়ানো যায়নি। আবার উচ্চমূল্যের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দীর্ঘদিন আমদানিও করা যায়নি। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেকের বেশি সক্ষমতাই বছরের বেশির ভাগ সময় অব্যবহূত থাকছে। এমনকি গত বছরের এপ্রিলে অতিরিক্ত চাহিদার মধ্যেও পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যায়নি।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছর স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৭০ ডলারে উঠে যায়। উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটির আমদানি ছিল এক প্রকার বন্ধ। বর্তমানে তা প্রতি এমএমবিটিইউ ১২-১৩ ডলারে ওঠানামা করছে। মূল্য কমায় এখন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গত বছরের তুলনায় সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও চাহিদার তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের চাহিদা ছিল ২ হাজার ১৭৪ এমএমসিএফডি। সেখানে সরবরাহ দেয়া হয়েছে ১ হাজার ১৪৫ এমএমসিএফডি। গ্যাস সংকটের কারণে ১ হাজার ২৯ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ দেয়া যায়নি। এর মধ্যে তিতাস গ্যাসের আওতাধীন ২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা ছিল ৭৫০ এমএমসিএফডি। সরবরাহ পেয়েছে ৪৪১ এমএমসিএফডি। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আওতাধীন ১৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা ছিল ৪২৩ এমএমসিএফডি। সরবরাহ মিলেছে ১৫৮ এমএমসিএফডি। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা ছিল ১৮৫ এমএমসিএফডি। সরবরাহ পেয়েছে ৬১ এমএমসিএফডি। জালালাবাদ গ্যাসের ১৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের প্রয়োজন ছিল ৩৯৫ এমএমসিএফডি। সরবরাহ হয়েছে ২৮৯ এমএমসিএফডি। ২৪৭ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে ১১৪ এমএমসিএফডি সরবরাহ পেয়েছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসের আট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা ছিল ১৭৪ এমএমসিএফডি। সেখানে সরবরাহ দেয়া হয়েছে ৭৯ এমএমসিএফডি। গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ আছে ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ দেয়া গেলে আরো অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সেটি করা গেলে লোডশেডিংও কিছুটা কমানো যেত। তবে বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর যে সক্ষমতা তাতে পূর্ণমাত্রায় সেগুলো চালানো কঠিন। পাশাপাশি অবকাঠামো সংকটের কারণে বিদ্যমান এলএনজি সরবরাহ এর বেশি হবে না। ফলে প্রকৃতভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কত সেটি জানা দরকার।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপিডিবি সাধারণত তুলনামূলক সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে গুরুত্ব দেয়। সেক্ষেত্রে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে জ্বালানি সরবরাহ সীমিত হওয়ায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াটের মতো হলেও সব ব্যবহার করা যায় না। অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন পুরনো। সেগুলোর কার্যকারিতা কম। কিছু কেন্দ্র নিয়মিত মেরামতে আছে। সে হিসেবে যে সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে, সেটিই বাস্তবিক সক্ষমতা।’
এদিকে তীব্র তাপদাহে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও গত দুদিনে দেড় থেকে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। বিশেষ করে মফস্বল শহর ও সেচে বিদ্যুৎ পেতে হিমশিত খাচ্ছে গ্রাহক।
পেট্রোবাংলা বলছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তীব্র গরমে, সেচ ও রোজায় যাতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সচল রাখা যায় সেজন্য নির্দেশনাও রয়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এলএনজিসহ জাতীয় গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ২ হাজার ৯১৬ এমএমসিএফডি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পাচ্ছে ১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফডি। বাকি গ্যাস যাচ্ছে শিল্প, সার, সিএনজি ও আবাসিকে।
বিপিডিবির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পুনরায় চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। খরচ বেশি হলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে এ পথে হাঁটতে হতে পারে বিদ্যুৎ বিভাগকে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানিও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।