এককালে বাংলাদেশের বড় পরিচয় ছিল নদীমাতৃক দেশ। সে পরিচয় ছাপিয়ে এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে ‘দূষিত নদীর দেশ’। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর প্রায় সবগুলোয়ই শিল্পবর্জ্য ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দেশের ৫৬টি প্রধান নদ-নদীর ওপর সম্প্রতি করা এক গবেষণার তথ্য বলছে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত নদী গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাঁড়িধোয়া ও হবিগঞ্জের সুতাং। এ গবেষণায় ৫৬টি নদ-নদীতেই সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি দূষণের অস্তিত্ব মিলেছে, তবে তুলনামূলক বেশি দূষিত নদী ওই তিনটি।
পরিবেশবিদরা বলছেন, শিল্পবর্জ্যের দূষণের সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি পৌরবর্জ্য নদী দূষণে নতুন মাত্রা যোগ করছে। এমন দূষণের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর অবস্থানে না গেলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ার পাশাপাশি বিশুদ্ধ খাবার পানির ঝুঁকিতেও পড়বে বাংলাদেশ।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) উদ্যোগে দেশের ৫৬টি প্রধান নদ-নদীর দূষণ নিয়ে এক বছরব্যাপী গবেষণাকর্ম শেষ হয়েছে সম্প্রতি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলমান এ গবেষণাকর্মের তথ্য প্রকাশিত হয় গত ১৪ মার্চ। গবেষণায় ৫৬টি নদীর পানির গুণাগুণ পরিমাপ করে দেখা গেছে, শুধু শহর বা উপশহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নদীতেও প্লাস্টিক ও শিল্পবর্জ্যের দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। নদী বহমান, তাই দূষণ স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে এক নদী থেকে অন্য নদীতে ছড়ায়।
গবেষণাকর্মটি পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত এক বছরে দেশের প্রধান প্রধান নদীর দূষণের মানমাত্রা নিয়েই এ গবেষণাকর্ম। সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসা দূষিত নদীগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয় গবেষণায়। নদীর স্বাস্থ্য ও জলজ চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দূষণের মূল চারটি প্যারামিটার সামনে রেখে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে পানির জারক প্রকৃতি, দ্রবীভূত অক্সিজেন, জৈব অক্সিজেনের চাহিদা (বিওডি) ও রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) পরিমাপ করে নির্ণয় করা হয় নদ-নদীর দূষণ। গবেষক দল জানায়, শুষ্ক মৌসুমে নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহ করা হয় স্যাম্পল। তবে এ গবেষণায় নদী দখল ও অন্যান্য প্যারামিটার আমলে নেয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এক বছর ধরে নদীগুলোর পানির স্যাম্পল নিয়ে কাজ করেছি। একটা সময় আমাদের উদ্বেগের কারণ ছিল শহর ও নগরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলো। কারণ শিল্প-কারখানা এসব অঞ্চলে বেশি। কিন্তু এবার আমরা দেখলাম এমন কোনো নদী নেই যেখানে দূষণ নেই। এর কারণ হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন শিল্প-কারখানা নির্মাণ হচ্ছে। ফলে দেখা গেছে, সুন্দরবনের আশপাশের নদীতেও দূষণ পাওয়া গেছে। নদীর স্রোত বয়ে চলে, তাই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতেও দূষণ ঘটছে। এছাড়া সব নদীতেই বিভিন্ন উৎস থেকে প্লাস্টিক দূষণও পাওয়া গেছে প্রচুর।’
গবেষণার তথ্যমতে, সবচেয়ে দূষিত তিন নদীর পানির গুণাগুণ প্রায় সমান। লবণদহ, হাঁড়িধোয়া ও সুতাংয়ে পানির ক্ষারতার পরিমাণ যথাক্রমে ৫, ৪ দশমিক ১ ও ৪। পানিবিজ্ঞানীদের মতে, বিশুদ্ধ পানির পিএইচ বা ক্ষারের পরিমাণ ছয় থেকে সাতের মধ্যে থাকতে হয়। এর কম হলে পানিকে আম্লিক এবং বেশি হলে ক্ষারীয় বলা হয়। পিএইচের মানমাত্রা বেশি ও কম দুটোই মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর।
তিন নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মানমাত্রা ভয়াবহ রকম কম। লবণদহে অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২১, হাঁড়িধোয়ায় শূন্য দশমিক ৬ ও সুতাংয়ে শূন্য দশমিক ৪। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানিবিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ অবশ্যই ৪ দশমিক ৫ থেকে ৮ মাত্রায় থাকতে হবে। নয়ত জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
এ তিনটি নদীতে অক্সিজেনের মানমাত্রা কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, ‘এত কম মাত্রার অক্সিজেনে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিভিন্ন সময় নদ-নদীর পানির গুণাগুণ পরিমাপ করি, তখন অক্সিজেনের মাত্রা আরো বেশি থাকে। নদীর পানি যেহেতু প্রবহমান, অক্সিজেনের মাত্রাটা আরো বেশি হওয়ার কথা। গবেষকরা যে অংশ থেকে স্যাম্পল কালেক্ট করেছেন, হয়তো সেখানে দূষণের পরিমাণ খুব বেশি ছিল। তবে আমাদের নদ-নদীগুলোতে যে মারাত্মক আকারে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। জলজ প্রাণী ও ইকোসিস্টেম রক্ষার জন্য অবশ্যই নদী দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে।’
বেশি দূষিত তিনটি নদীর পানির জৈব অক্সিজেনের চাহিদা (বিওডি) এবং রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) পরিমাপ করে দেখা গেছে বিশুদ্ধ পানিতে যে পরিমাণ এসব উপাদান থাকা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এসব নদ-নদীর দূষিত পানি প্রাণ-প্রতিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
উত্পত্তি ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ তিনটি নদীই সমৃদ্ধ জনপদ গড়তে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে।
জনশ্রুতি আছে লবণদহ একসময় লবলং সাগর ছিল। একসময় এ নদ বা সাগর দিয়ে চলত পালতোলা নৌকা, শোনা যেত মাঝির আকুল করা গান। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তঘেঁষা ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার ক্ষীরু নদীর সংযোগস্থল থেকে উত্পত্তি লবণদহের। এরপর আঁকাবাঁকা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মির্জাপুরের কাছে তুরাগ নদে এসে মিশেছে। একসময়ের প্রমত্তা নদ এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে ‘লবণদহ খাল’ হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। হারিয়ে ফেলেছে তার নদী চরিত্র। এখন কেউ বলে লবলং খাল আবার কেউ বলে লবলং নালা। লবণদহ দখল ও ভরাট করে নদের ওপরে বা গতিপথ পরিবর্তন করে গড়ে উঠেছে অনেক কলকারখানা। বর্তমানে এ খালের শ্রীপুর অংশে প্রায় ৩০ কিলোমিটারজুড়ে চলছে দখল-দূষণ।
নরসিংদী জেলা শহর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা হাঁড়িধোয়া নদীটি একসময় এ জেলাবাসীর জন্য আশীর্বাদ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এ নদীপথের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। পাশাপাশি নদীপারের মানুষের কৃষিজমি যেমন ছিল ফসলে ভরা, তেমনি নদীর পানিতে ছিল প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ। দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত দখল আর শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে এ নদী এখন এলাকাবাসীর জন্য অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম ও শিবপুর উপজেলার পশ্চিম-উত্তর শীতলক্ষ্যা নদীর কোণ থেকে প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা হয়ে নদীটি জেলা শহরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে এসে মেঘনা নদীর মোহনায় মিলিত হয়েছে। এখন আর মাছ পাওয়া যায় না, এমনকি পশুপাখির জন্যও সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে হাঁড়িধোয়া নদীর পানি।
সুতাং বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হবিগঞ্জে নদীটির দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। পাহাড়ের কোলঘেঁষা সুতাং নদী এককালে ছিল খরস্রোতা। কালের আবর্তনে নদীর এ ঐতিহ্যও হারিয়ে যাচ্ছে।
গাজীপুরের লবণদহ নদী নিয়ে দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘লবণদহের এখন যে অবস্থা এটিকে আর নদী বলার সুযোগ নেই। শিল্প বর্জ্যে লবণদহের পানির রঙ কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। তার ওপর আছে নগরীর প্লাস্টিক বর্জ্য এবং পৌরসভার সব ধরনের আবর্জনা। দেশের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে লবণদহ একটি। এ নদীকে বাঁচাতে আমরা দীর্ঘদিন কাজ করলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।’
গবেষণার অন্য নদীগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গীখাল, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, ইছামতী, মেঘনা, খিরু, শিলা, লোয়ার বানার, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, পশুর, তিতাস, বংশী, চিলাই, কর্ণফুলী, খোয়াই, বাঁকখালী, ভৈরব, মাতামুহুরী, সুরমা, আত্রাই, ময়ূর, চিংড়ি, হালদা, নাফ, করতোয়া, যাদুকাটা, চিত্রা, রূপসা, কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, পায়রা, বিশখালী, মাথাভাঙ্গা উল্লেখযোগ্য।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী নদী একটি জীবন্ত সত্তা। দেশের সংবিধান অনুযায়ী নদী হচ্ছে জনগণের সম্পত্তি। অথচ নদীগুলোর ব্যবস্থাপনায় আমরা কোনো কার্যকর উদ্যোগই গ্রহণ করিনি। ওয়াসার কাছে নদী হচ্ছে পয়োবর্জ্য ফেলার একটা জায়গা, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কাছে নদী হচ্ছে গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলার জায়গা আর সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে নদী হচ্ছে তাদের অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলার জায়গা। আমাদের উন্নয়নের মডেলটাই এমন যে নদীকেই আমরা বর্জ্য ফেলার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করব এবং সেটা করে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব তা দিয়েই আমরা উন্নয়ন করব। দেশের আইন-আদালতের নির্দেশ তো সম্পূর্ণ বিপরীত।’