উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে। এক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থীদের খুঁজে নেয়ার জন্য শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে। এভাবেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক কিছু তথ্যের আলোকে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ব-অর্থায়নে পড়াশোনার দিকটি উঠে আসছে। এক্ষেত্রে কেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) অনুন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পড়তে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন সেটির কারণ জানা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। যেহেতু বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা হয়, সে হিসেবে ইউএইতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে খোঁজ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এজন্য হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি ও দুবাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খতিয়ে দেখা উচিত।
বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কাছে বিদেশে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত কিউএস র্যাংকিংয়ে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান ১৫০-এরও পরে। তার পরও গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যকই মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি ও দুবাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গেছেন।
অথচ গোটা বিশ্বেই উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর ব্যতিক্রম বাংলাদেশেও দেখা যায়নি। তাহলে কী কারণে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ভর্তি হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেল, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার বলে দেশের শিক্ষাবিদরা মত দিয়েছেন। এটা ঠিক যে প্রবাসী হিসেবে আবুধাবি-দুবাই সব সময়ই বাংলাদেশীদের শীর্ষ গন্তব্য ছিল। সে ধারাবাহিকতায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিবারের সদস্যরা সেখানে বসবাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, অনেক বাংলাদেশী বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে ইউএইর গোল্ডেন ভিসা নিয়েছেন। বিশেষ এ কার্ডধারী বিত্তবানদের সন্তানরা ১০ বছরের রেসিডেন্সিয়াল সুবিধাসহ সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে এখন বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। পাশাপাশি উন্নত দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই দুবাই-আবুধাবির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। মোটা দাগে এ বিষয়গুলোর কারণেই এখন দুবাই ও আবুধাবিসহ আরব আমিরাতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তবে উচ্চশিক্ষায় দুবাই-আবুধাবির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের যোগসূত্র থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা দুবাই-আবুধাবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশি খরচ দিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। আবার সেখানে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়ার তেমন নজিরও দেখা যায় না। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আরব আমিরাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুনাম অর্জন করতে পারেনি। এর আগে মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা গেছে। দেশটির বিপুলসংখ্যক অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করেই বাংলাদেশীদের উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে সেটি নিম্নগামী হলেও বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পদচারণা বেড়ে গেছে।
এছাড়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস রয়েছে। যেমন আবুধাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস রয়েছে। কাতারে কার্নেগি মেলন, জর্জটাউন এবং টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস মধ্যপ্রাচ্যের দেশে রয়েছে। এসব স্যাটেলাইট ক্যাম্পাসে তুলনামূলক কম খরচে পড়াশোনা করা যায়। তাই অর্থ পাচারের অভিযোগ ঢালাওভাবে না এনে মধ্যপ্রাচ্যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। তাছাড়া যারা আগে থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসরত, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পড়াশোনা করা খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়।
মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিষয়টি পুরো বিশ্বই গুরুত্ব দেয়। তাই সেখানে বিশ্বব্যাপী পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা খোলাকে অস্বাভাবিকভাবে দেখার কিছু নেই। আবার যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অধ্যয়ন করছেন, সেখানকার পাশাপাশি দুবাই-আবুধাবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমাদের দেশের শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত বিদেশে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের ব্যাংকের স্টুডেন্ট ফাইল পর্যালোচনা করা। যেহেতু স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে হলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়, সে হিসেবে অন্তত সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাবে। এদিকে বর্তমানে দু-একটি ব্যাংক ছাড়া দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক বিদেশে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্টুডেন্ট ফাইল’ খুলছে না। কারণ হিসেবে ব্যাংকে ডলার সংকটের কথা বলা হচ্ছে। যে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাচ্ছেন তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খুলতে হয়। যার মাধ্যমে অভিভাবকরা সহজেই শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি, টিউশন ফি, আবাসন ফিসহ অন্যান্য খরচ পাঠাতে পারেন। যেহেতু ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়, সে হিসেবে বর্তমানে কীভাবে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইউএইতে পড়াশোনা করছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে অবৈধ চ্যানেল অর্থাৎ হুন্ডির আশ্রয় নেয়া হয়েছে কিনা সেটি যাচাই করে দেখতে হবে।
বৈধভাবে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, সন্তানদের স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিপুল অর্থ খরচ করে পড়ানোর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই গণ্য হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে যারা আগে থেকেই স্টুডেন্ট ভিসার মাধ্যমে সেখানে পড়াশোনা করছেন তারা দেশটিতে বৈধভাবেই অবস্থান করছেন। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে নিকট অতীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে গেছে, যা আমাদের ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে হয়নি। আমাদের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের পেছনে এটিও একটি বড় কারণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। বিদেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন, এটি খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্যের অখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে বিপুল অর্থ খরচ করে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে হুন্ডির বিষয়টিও দায়ী কিনা সেটি তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। কারণ ডলার সংকটের ফলে আগে থেকে অধ্যয়নরতদের জন্য অর্থ প্রেরণে যেহেতু আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ কঠিন হয়ে গেছে, তাই দেশের স্বার্থেই বিদেশে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থীদের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে খোঁজ নিতে হবে।