ভূ-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বাজারে পণ্য রফতানির বিশাল বাজার হারাচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে চীন থেকে ক্রমাগত সরিয়ে নিতে চাইছে। এক্ষেত্রে ইউরোপের বিশাল বাজারে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রফতানিতে জায়গা করে নিতে পারে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের কারণে ২০২৯ সালের মধ্যে ইউরোপের বাজারে পোশাক রফতানিতে জিএসপি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বৈশ্বিক করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৯ সালের পর আরো অন্তত তিন বছর জিএসপি সুবিধা চায় তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সংগঠন বিজিএমইএ।
রিসার্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) আয়োজিত গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ফিফটি
ইয়ারস অব ইইউ-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ: চার্টিং অ্যাহেড অন এ লিগেসি অব সাকসেস’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এ দাবি জানান। র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং পরিচালক ড. মো. আবু ইউসুফ সমাপনী বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, এফইএসের আবাসিক প্রতিনিধি ফিলিক্স কোলবিটজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ,
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিএডি) উপপরিচালক ড. মিজান রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপারসন ড. লাইলুফার ইয়াসমিন, ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. নাজনিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ইউরোপে
তৈরি পোশাক ছাড়াও বিভিন্ন মানসম্পন্ন পণ্য রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া-পরবর্তী উদ্বেগ না করে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পোশাক খাতে কীভাবে বৈচিত্র্য আনা যায় আমরা সেই চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘করোনা
মহামারী, রোহিঙ্গা সমস্যা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক যতগুলো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সবগুলোর কারণেই আমরা ভুক্তভোগী। এজন্য ইউরোপকে আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে। ২০২৯ সালের আগে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার না করে আমাদের ইউরোপের বাজারে আরো কমপক্ষে তিন বছর সময় দেয়া উচিত।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লজ হোয়াইটলি বলেন, ‘জ্বালানির
মূল্যবৃদ্ধিসহ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ ভুক্তভোগী দেশ। এখানে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে আমরা এখানে আরো বিনিয়োগ করতে পারি।’
বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এখানকার তৈরি পণ্য বিশ্বমানের।’
দ্বিপক্ষীয় আলোচনা গতিশীল এবং বাংলাদেশের রফতানি বৈচিত্র্য বাড়ানোর গুরুত্বারোপ করে ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘আমরা
উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছি। একই সঙ্গে বলতে হয়, আমরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। কারণ তৈরি পোশাকসহ অনেক খাতে আমদানিনির্ভর পণ্য এনে আবার রফতানি করতে হয়। এর পরও ইউরোপের বাজারে টিকে থাকতে যেসব বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে উঠছি।’
অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অর্থ
কি শুধু বিদেশে পাচার হচ্ছে, দেশের ভেতর হচ্ছে না? একজন মানুষ দেশের ভেতরে নিরাপদ বিনিয়োগ করতে না পারলে অন্য দেশকে নিরাপদ ভাবে, নতুন পথ খুঁজতে থাকে। এজন্য দেশের ভেতরে নিরাপদ বিনিয়োগ ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। পাশাপাশি অর্থ পাচার রোধে আমাদের বৈশ্বিকভাবে পরস্পর সহযোগিতা দরকার।’
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘মধ্যম
আয়ের দেশে পরিণত হলেই যে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে বড় ধাক্কা খাবে সেটা কেন, তৈরি পোশাক রফতানিতে কি শুধু বাংলাদেশেরই লাভ। এতে ইউরোপ কি লাভবান হচ্ছে না?’
তিনি বলেন, ‘ইউরোপের
দেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে কি ইউরোপের কিছুই করার নেই।’
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষা
ও প্রশিক্ষণে ইইউ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে আসছে। ক্রমশ পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এ সহায়তা আরো জোরদার করা যেতে পারে।’
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০০০ সালে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ২৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এছাড়া বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে যে পরিমাণ রফতানি করেছে তার মধ্যে ইউরোপে ২৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ ও যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ। ইউরোপে এ মুহূর্তে চীনের সাপ্লাই চেইনের বাজার নেমেছে ২৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৯-এর আগে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ইউরোপের বাজারে অবাধে পণ্য রফতানির সুযোগ পাবে ভিয়েতনাম। একই সময়ে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হবে। তবে রফতানি বাণিজ্যর অবস্থান ধরে রাখতে হলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, শ্রমবান্ধব পরিবেশসহ সব ধরনের বাধ্যবাধকতা মানতে হবে বাংলাদেশকে।
প্রসঙ্গত, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য রফতানি বাজারে অগ্রাধিকারমূলক শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পরিবর্তন হবে। ২০২৬ সালের এলডিসি উত্তরণের পর পরই কানাডা, চীন, ভারত ও জাপানের বাজারে জিএসপি সুবিধা পরিবর্তন বা স্থগিত হয়ে যাবে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা থাকবে। এরপর শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকারের জন্য ইইউর জিএসপি প্লাস প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করতে পারবে।