আমার বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে
তিন দশকের
অধিক সময়
শিক্ষকতা এবং
এ দেশের
প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়
ইস্ট ওয়েস্ট
ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের
দায়িত্বে আট
বছরের অভিজ্ঞতার
আলোকে আমি
বলতে পারি,
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা
ব্যবস্থায় পরিবর্তন
আনা দরকার।
অবশ্য এ
পরিবর্তনের প্রয়োজন
দেখা দিয়েছে
বর্তমান চতুর্থ
শিল্প বিপ্লবের
চাহিদা পূরণে।
এটা স্বীকৃত
যে সামাজিক
অবস্থা, অর্থনীতির
প্রকৃতি, সমাজের
জনসংখ্যাগত চরিত্র
আর প্রযুক্তির
পরিবর্তন শিক্ষা
ব্যবস্থায় পরিবর্তন
আনে এবং
পাঠদান পদ্ধতিকেও
প্রভাবিত করে।
কাজেই এ
পরির্বতন বিশ্ববিদ্যালয়ের
ইচ্ছাধীন নয়।
এটার যথার্থতা
বোঝা যাবে
বিভিন্ন শিল্প
বিপ্লব কীভাবে
শিক্ষা ব্যবস্থায়
পরিবর্তন এনেছে
এবং পাঠদান
পদ্ধতিকেও প্রভাবিত
করেছে তা
বিশ্লেষণ করলে।
প্রথম দুই
শিল্প বিপ্লবের
সময় প্রযুক্তিগত
এবং কর্মক্ষেত্রে
দক্ষতাসম্পন্ন অধিক
শিক্ষিত কর্মী
বাহিনীর চাহিদা
বৃদ্ধি পায়,
তাই সব
স্তরের শিশুরা
স্কুলে যেতে
শুরু করে।
উনিশ শতকের
মাঝামাঝি শিক্ষকরা
শিক্ষাদানে চকবোর্ড
ব্যবহার শুরু
করেন। দ্বিতীয়
শিল্প বিপ্লবের
সময় আশির
দশকের শেষ
দিকে হোয়াইটবোর্ড
শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার
শুরু হয়।
প্রাক-শিল্প
বিপ্লব যুগে
শিশুদের ঐতিহ্য,
রীতিনীতি, আচার
এবং ধর্ম
সম্পর্কে শিক্ষিত
করা হতো।
আধুনিক শিক্ষায়
শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান,
প্রযুক্তি, ভাষা,
গণিত এবং
অন্যান্য বিষয়
সম্পর্কে পড়ানো
হয়। হেনরি
ফিশেল, একজন
মার্কিন ব্যবসায়ী,
উনিশ শতকের
শেষের দিকে
ছাত্রদের মূল্যায়নের
জন্য পরীক্ষার
ধারণাটি দেন।
চীন ছিল
প্রথম দেশ
যারা প্রথম
পরীক্ষা পদ্ধতি
চালু করেছিল।
১৯০৫ সালে
রবার্তো নেভিলিস,
ভেনিসের একজন
শিক্ষক, ক্লাসে
পঠিত বিষয়বস্তু
যেসব ছাত্র
ভালোভাবে বুঝতে
পারত না,
তাদের জন্য
অ্যাসাইনমেন্ট উদ্ভাবন
করেছিলেন। ১৯০৬
সালে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে কার্নেগি
ফাউন্ডেশন প্রথম
ক্রেডিট পদ্ধতিতে
কোর্সের জন্য
ক্রেডিটের সংজ্ঞা
দেয়। কম্পিউটারাইজেশন,
ডিজিটাইজেশন এবং
ওয়েবভিত্তিক আন্তঃসংযোগ
ছিল তৃতীয়
শিল্প বিপ্লবের
ফল। শিক্ষকরা
পাঠের সময়
ব্ল্যাকবোর্ড এবং
হোয়াইটবোর্ড ব্যবহার
করার পাশাপাশি
ওভারহেড প্রজেক্টর
এবং ইন্টারনেট
ব্যবহার শুরু
করেন।
সমাজ চেয়েছে
শিক্ষিত জনগোষ্ঠী
আর তা
তৈরি করতে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সময়োপযোগী
শিক্ষা ব্যবস্থা
ও পাঠদান
পদ্ধতি চালু
করে। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে ড.
হাওয়ার্ড ল্যাম্ব
প্রস্তাবিত ‘ফ্যাক্টরি
মডেল’ সিস্টেমটি
হেনরি ফোর্ডের
গাড়ি উৎপাদন
কারখানার সমাবেশ
লাইনের মাধ্যমে
জনপ্রিয় করা
হয়েছিল। স্কুলগুলো
মূলত শিল্প
বিপ্লবের সময়
ভবিষ্যতের কারখানার
কর্মীদের ব্যবহারভিত্তিক
জ্ঞানে শিক্ষিত
করার প্রয়োজনে
শিক্ষার ফ্যাক্টরি
মডেলটি ব্যবহার
শুরু করে।
সমাজের চাহিদা
পূরণে অনেক
শিক্ষণ মডেল
যেমন লেকচার,
কো-অপারেটিভ
লার্নিং, অনুসন্ধানভিত্তিক
শিক্ষা, সেমিনার
এবং প্রকল্পভিত্তিক
শিক্ষা প্রবর্তিত
হয়। তিনটি
শিল্প বিপ্লবেই
শিক্ষা ব্যবস্থাকে
চিহ্নিত করা
হয় পরীক্ষায়
ভালো ফলাফলের
জন্য ছাত্রদের
মুখস্থনির্ভর করা
এবং একমুখী
প্রক্রিয়া, যেখানে
শিক্ষকরা ইনপুট
হিসেবে পড়ান
আর শিক্ষার্থীরা
মূলত তথ্যের
ভোক্তা।
চতুর্থ শিল্প
বিপ্লবের ধরন
ও প্রকৃতি
আগের তিনটি
শিল্প বিপ্লব
থেকে আলাদা।
আগের বিপ্লবগুলো
মানুষকে প্রতিস্থাপন
করেছে, কিন্তু
তার চিন্তাভাবনা
নয়। কিন্তু
চতুর্থ শিল্প
বিপ্লব এটাও
করবে। তাহলে
মানব আর
কি মানবসম্পদ
হিসেবে বিবেচিত
হবে না!
বিষয়টি অনেককে
ভাবিত করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন
কি ফুরিয়ে
যাচ্ছে? অবশ্যই
না, আরো
গুরুত্ব পাচ্ছে।
তবে যেটা
অপ্রয়োজনীয় হতে
চলেছে, তা
হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের
জ্ঞান প্রদানে
দায়িত্ব পালন
করা আর
শিক্ষকরা হোয়াইটবোর্ড
ও মাল্টিমিডিয়া
ব্যবহার করে
ছাত্রদেরকে তথ্য
প্রদান করা।
ছাত্ররা শিখছে
কিনা সে
বিষয়টি বরাবর
উপেক্ষিত থেকে
যায়। পাঠ্যক্রমটি
পাঠ্যপুস্তকের ওপর
ভিত্তি করে
প্রণয়ন করা
হয়, যেখানে
শিক্ষার্থীদেরকে তাদের
কর্মজীবনে প্রয়োজনীয়
দক্ষতাগুলোকে উপেক্ষা
করে। বর্তমানে
কী ধরনের
পাঠ্যক্রমের প্রয়োজন
তা জানতে
আমাদের সর্বাগ্রে
জানতে হবে
চতুর্থ শিল্প
বিপ্লব কী
চায়?
বর্তমান ও
ভবিষ্যতের কর্মজীবী
মানুষের যেসব
দক্ষতা থাকা
দরকার তা
হলো: মৌলিক
দক্ষতা (পড়া,
লেখা ও
গণিত), ফাউন্ডেশন
দক্ষতা (কীভাবে
শিখতে হয়
তা শেখা),
যোগাযোগ দক্ষতা
(শোনা ও
মৌখিক যোগাযোগ),
অভিযোজনযোগ্যতা (সৃজনশীল
চিন্তাভাবনা ও
সমস্যা সমাধান),
গ্রুপ কার্যকারিতা
(আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা,
আলোচনা ও
দলগত কাজ),
প্রভাব (সাংগঠনিক
কার্যকারিতা ও
নেতৃত্ব), ব্যক্তিগত
ব্যবস্থাপনা (আত্মসম্মান
ও প্রেরণা/লক্ষ্য
নির্ধারণ), মনোভাব
(ইতিবাচক জ্ঞানীয়
শৈলী) ও
প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা
(পেশাগত ও
পেশাদার দক্ষতা)।
উল্লিখিত দক্ষতাগুলো
মেশিন দিয়ে
কোডিং করা
যায় না।
চাকরি করার
জায়গাগুলোয় এখন
এসব দক্ষতা
চাওয়া হচ্ছে।
ফলে শিক্ষার্থীরা
এ দক্ষতাগুলো
শিখে আসবে,
এটাই প্রত্যাশা
করা হচ্ছে।
কাজেই কর্মীদের
দক্ষতা সেটে
পরিবর্তনের কারণে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই শিক্ষা
ব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা
ও পুনর্বিন্যাস
করতে হবে।
প্রথমে পাঠ্যক্রমে
দক্ষতাগুলো সন্নিবেশিত
করতে হবে।
কাজটি সহজ
নয়। এ
বিষয়ে বিশেষজ্ঞের
সাহায্য দরকার
হবে। শিক্ষকদের
দায়িত্ব হবে
এমন পাঠ্যদান
পদ্ধতি গ্রহণ
করা যাতে
শিক্ষার্থীরা দক্ষতাগুলো
অর্জন করে।
কোর্স শিক্ষক
পরীক্ষা, প্রকল্প
মূল্যায়ন, উপস্থাপনা
ইত্যাদির মাধ্যমে
প্রতিটি শিক্ষার্থীর
দক্ষতা অর্জনের
মূল্যায়ন করার
ব্যবস্থা নিতে
হবে। বর্তমানে
পৃথিবীর অনেক
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
আউটকাম বেজড
এডুকেশন (ওবিই)
গ্রহণ করেছে।
এটি একটি
ছাত্রকেন্দ্রিক শিক্ষণ
ও শেখার
পদ্ধতি যেখানে
নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য
এবং ফলাফল
(আউটকাম) অর্জনের
জন্য কোর্স
ডেলিভারি ও
মূল্যায়নের পরিকল্পনা
করা হয়।
শিক্ষার্থীরা কখন
ও কোথায়
শিখবে তার
চেয়ে শিক্ষার্থীরা
কী এবং
কেন শিখছে
তা বেশি
গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাবে
বলা যায়
যে অভীষ্ট
আউটকামগুলো অর্জন
এবং সেগুলো
পরিমাপ করা
একটি প্রোগ্রামের
জন্য বেশি
গুরুত্বপূর্ণ। এ
স্বল্প পরিসরে
ওবিই সম্পর্কে
বিস্তারিত আলোচনা
করা সম্ভব
নয়। শিক্ষণ
শৈলী ও
পদ্ধতিতেও পরিবর্তন
আনতে হবে।
গবেষণায় দেখা
গেছে, শিক্ষার্থীরা
সাধারণত শিক্ষকের
৫০ মিনিটের
লেকচার শোনার
প্রতি মনোযোগ
হারায় এবং
এর ফলে
তারা পড়াশোনায়
আগ্রহ হারিয়ে
ফেলে। এর
কারণ হচ্ছে
মানবমস্তিষ্ক যেভাবে
স্বল্প মেমরি
(short memory) এবং কার্যকারী
মেমরির (working
memory) মাধ্যমে
তথ্য প্রক্রিয়া
করে এবং
দীর্ঘমেয়াদি মেমরি
(long-term memory) তথ্য
সংরক্ষণ করে
তা দীর্ঘ
লেকচার সমর্থন
করে না।
স্বল্পমেয়াদি মেমরি,
মেমরির প্রথম
অংশ, মাত্র
চার খণ্ড
তথ্য ধারণ
করতে পারে।
স্বল্পমেয়াদি মেমরিতে
থাকা তথ্যও
স্বল্পস্থায়ী, যদি
তা অনুশীলন
না করা
হয় তবে
৬০ সেকেন্ড
পর অদৃশ্য
হয়ে যায়।
স্বল্পমেয়াদি মেমরির
তথ্য ধারণ
করার এ
সীমাবদ্ধতার কারণে
ওয়ার্কিং মেমরি
যে পরিমাণ
তথ্য প্রক্রিয়াকরণের
জন্য অ্যাকসেস
করতে পারে
তার পরিমাণকে
প্রভাবিত করে।
স্বল্পমেয়াদি মেমরি
যখন প্রচুর
তথ্য পায়,
তখন ওয়ার্কিং
মেমরি ওভারলোড
হয়ে যায়
এবং পুরো
তথ্যের মাত্র
একটি অংশ
দীর্ঘমেয়াদি মেমরিকে
প্রক্রিয়ার জন্য
পাঠায়। এটি
একটি কারণ
যে শিক্ষা
গবেষকরা লেকচারভিত্তিক
শিক্ষণের কার্যকারিতা
নিয়ে প্রশ্ন
তুলছেন। তারা
লার্নিং প্যারাডাইম
(learning Paradigm)-এর
পক্ষে জোরালো
মতামত দিচ্ছেন।
এ প্যারাডাইমটি
এ ধারণার
ওপর ভিত্তি
করে তৈরি
করা হয়েছে
যে কার্যকরভাবে
শেখার জন্য
শিক্ষার্থীদের নিজেদের
জ্ঞান গঠন
ও পুনর্গঠন
করতে হবে।
লার্নিং প্যারাডাইমের
উদ্ভাবন পরীক্ষায়
ছাত্রদের উর্ত্তীণ
করার জন্য
কিছু করার
পরিবর্তে একটি
জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া
হিসেবে শেখার
ওপর ভিত্তি
করে হয়েছে।
বিপরীতে আমাদের
দেশে প্রচলিত
পরম্পরাগত শিক্ষণ
পদ্ধতিতে এ
শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয়
শিক্ষার্থী এবং
তারা ক্লাসে
নোট গ্রহণ
ও পরবর্তী
সময়ে পরীক্ষার
জন্য তথ্য
মুখস্থ করে।
যারা মুখস্থ
করতে পারে
না বা
ক্লাসে অমনোযোগী
থাকে, তাদের
মধ্যে পরীক্ষায়
নকল করার
প্রবণতা বৃদ্ধি
পায়। কাজেই
পরম্পরাগত শিক্ষণ
পদ্ধতি বদলাতে
হবে।
এখানে ইস্ট
ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য হিসেবে
বলতে পারি,
আমাদের বোর্ড
অব ট্রাস্টিজের
সদস্যরা এবং
আমাদের শিক্ষক
কমিউনিটি পরিবর্তনের
প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি
করে পরিবর্তনের
পদক্ষেপ গ্রহণ
করেছে এবং
সুফল পাচ্ছে।
তাই বাংলাদেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিবর্তিত
সমাজের চাহিদা
অনুসারে তাদের
ভূমিকা পরিবর্তন
করেই অবদান
রাখতে হবে।
এরই মধ্যে
আমরা বিশ্বের
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে অনেক
পিছিয়ে আছি,
কাজেই আর
দেরি করা
যাবে না।
একটি উন্নত
দক্ষতা ও
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ
গড়ে তুলতে
আমাদেরকেই দায়িত্ব
নিতে হবে।
অধ্যাপক এমএম
শহিদুল হাসান
উপাচার্য, ইস্ট
ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
Email: [email protected]