২০১৪ সাল। গবেষণা, উদ্ভাবন, ইনকিউবেশন এবং বাণিজ্যিকীকরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফেরেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল গবেষক ড. খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেমস ল্যাব’ (এইমস ল্যাব) নামক একটি গবেষণাগার। যেখানে মানুষের সমস্যা নিয়ে গবেষণা ও এর সমাধান খুঁজে বের করতে কাজ করছেন তিনি।
বর্তমানে এ ল্যাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নে ২০টিরও বেশি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি গবেষণা প্রকল্প হচ্ছে সিএমইডি হেল?থ। লক্ষ্য স্বাস্থ্যসেবায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। ২০১৬ সালে আইসিটি বিভাগের ইনোভেশন ফান্ডের সহায়তায় গবেষণাকাজ সম্পন্ন করে একই বছর বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। এছাড়া এ মডেল এরই মধ্যে শীর্ষ আন্তর্জাতিক জার্নাল এলসেভিয়ারে প্রকাশিত হয়েছে এবং পেটেন্ট অর্জন করেছে।
সিমেড হেলথের উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের একটি করে ডিজিটাল স্বাস্থ্য অ্যাকাউন্ট (স্বাস্থ্য কার্ড) তৈরি করা এবং স্মার্ট মেডিকেল ডিভাইস যেমন আইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের দোরগোড়ায় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা, অসংক্রামক ব্যাধি, মা, শিশু ও কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্যসেবা, অভিজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে ২৪/৭ টেলিমেডিসিন, হেল?থ রেকর্ড ও কার্যকর রেফারেল সিস্টেম নিশ্চিত করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখা।
এ স্বাস্থ্যসেবার মডেলটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ৪০ লাখেরও অধিক মানুষকে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া করপোরেট অফিস, ফ্যাক্টরিতে ডিজিটাল হেলথ কর্নারের মাধ্যমে কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে এবং গ্রামীণ ও শহুরে এলাকাভিত্তিক ডিজিটাল জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) মডেলের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে কম্প্রিহেনসিভ স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সিমেড হেল?থ স্টার্টআপ হিসেবে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিস্বরূপ ডিবিএস-নাস সোশ্যাল ইনোভেশন-২০১৮ (সিঙ্গাপুর), সিডস্টারওয়ার্ল্ড ২০১৮ (সুইজারল্যান্ড), এপিকটা ২০১৯ (ভিয়েতনাম), বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন ড. খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন।
এছাড়া এইমস ল্যাব থেকে অটিজম শিশুদের জন্য উদ্ভাবিত ‘বলতে চাই’ এবং ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ অ্যাপ দুটি এনডিডি ট্রাস্ট, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২ এপ্রিল এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর এ ল্যাবের স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং টুল-বিএসস্ক্যান অ্যাপ ক্লিনিক্যালি বৈধতা পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস ল্যাব প্রতিষ্ঠা হয়েছে এখানে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি (বিএইচটিপিএ) আইসিটি বিভাগের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করে এ ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) রিসার্চ ল্যাব। বাংলাদেশে হিউম্যান কম্পিউটার ইন্টারফেস, ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস, বায়োমেডিক্যাল এবং রিহ্যাবিলিটেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ ল্যাব অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
এ ল্যাব এরই মধ্যে চারটি বিসিআই প্রকল্প শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ডিপ-ডিপ্রেশন: মানব মস্তিষ্কে প্রাথমিক পর্যায়ে হতাশা শনাক্তকরণের স্মার্ট ডায়াগনস্টিক যন্ত্র; ফোকাসমাইন্ড: কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করতে মিটিং অংশগ্রহণকারীদের একাগ্রতা বাড়ানোর জন্য একটি ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম; কনসেনট্রেট টুডে: মনোযোগ বাড়ানোর রিয়েল-টাইম ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসভিত্তিক নিউরোফিডব্যাক সিস্টেম; মার্কেটব্রেইন: উন্নত বিপণন গবেষণার জন্য একটি নিউরোমার্কেটিং সিস্টেম।
২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় জাতীয় পর্যায়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২২’-এর কারিগরি-বেসরকারি (শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি) ক্যাটাগরিতে ড. খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুনকে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইউআইইউর কম্পিউটার সায়েন্সে অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেমস ল্যাবের (এইমস ল্যাব) পরিচালক ড. খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বর্তমানে আমি এবং ইউআইইউ একাডেমিয়া, ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের মধ্যে সক্রিয় যোগসূত্র স্থাপন করার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। তারই ধারাবাহিকতায় ইউআইইউ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ, ইনোভেশন, ইনকিউবেশন অ্যান্ড কমার্শিয়ালাইজেশন (আইআরআইআইসি) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশে গবেষণা, উদ্ভাবন, ইনকিউবেশন এবং বাণিজ্যিকীকরণ সংস্কৃতি পরিচালনা করা হবে। এটি ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া গবেষণা সহযোগিতা, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ও উদ্ভাবনী জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।