বর্তমানে বিশ্বে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ৫৬ শতাংশ নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত। নারীর ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে আছে ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার। তার পরের অবস্থানে সার্ভিক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার। এ দুটি ক্যান্সারই প্রতিরোধযোগ্য, মানে শুরুতেই যদি শনাক্ত করা যায় তাহলে দুটি ক্যান্সার শত ভাগ নিরাময়যোগ্য। ব্রেস্ট ক্যান্সার ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারে স্ক্রিনিংয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীং অনেক বেশি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে নারীদের কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। তারা ঠিকমতো তাদের সন্তানদের ব্রেস্টফিড করতে পারছে না বা করছে না। যা পরোক্ষভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ১৫-১৬ বছরের কিশোরীরা ডিভাইসে বা গেমসে আসক্ত, সে কারণে মাঠে খেলাধুলা বা শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে না, তাতে তাদের ওবেসিটি বাড়ছে। এই ওবেসিটিও ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
যারা স্থূলকায় তাদের শরীরে ফ্যাটসেল বেশি থাকে। এই ফ্যাটসেল এস্ট্রোজেন নামে একটা হরমোন উৎপাদন করে। সে এস্ট্রোজেন হরমোনের যদি ওভার এক্সপোজ হয় মানে শরীরে অনেক বেশি পরিমাণে থাকে তাহলে তা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই ওবেসিটি পরোক্ষভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী বাড়াচ্ছে।
আমাদের দেশে নারীর মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের হারও অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব। আমাদের দেশের নারীরা বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা অসচেতন। নিজেদের ব্যাপারে তারা খুব উদাসীন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকটা তারা ঠিকঠাক মেনে চলছেন না। যেমন মাসিকের সময়ে কাপড় ব্যবহার না করা বা পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা এ বিষয়গুলোয় তাদের যথেষ্ট গাফিলতি আছে, অবহেলা আছে। এখান থেকেই অনেক নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ৯০ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যান্সার একটা ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে, যেটাকে আমরা বলি হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দিয়েই সেটা অনেকখানি নির্মূল করা যায়। এছাড়া এ ভাইরাসটির বিপরীতে একটি ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। ১৫-৪৫ বছরের নারীরা যদি এ ভ্যাকসিন নিতে পারেন।
নারীর স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারের পর যদি আমি তৃতীয় র্যাংকিং করতে চাই তাহলে তা হলো ওরাল ক্যাভিটি ক্যান্সার। এ ক্যান্সারটি পান সুপারি জর্দা এগুলোর মাধ্যমে হচ্ছে। ফুসফুস ক্যান্সারও হচ্ছে। কারণ গ্রাম দেশে কিছু নারী বা অনেক হাই সোসাইটির নারী ধূমপান করছেন। এছাড়াও কিছু জেনেটিক মিউটেশন আছে যেটার জন্য লাং ক্যান্সার হয়ে থাকে। এছাড়া মলদ্বারের ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও লাইফস্টাইল মডিফিকেশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে সঙ্গে কাজ করে ফ্যামিলি হিস্ট্রি। পরিবারে কেউ যদি রেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন বা কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, সেসব পরিবারের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে কারো আক্রান্ত হওয়ার ১০ শতাংশ আশঙ্কা থাকে। কোলন ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও পারিবারিক ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কিছু জিনগত কারণে বা জেনেটিক মিউটেশনের কারণে এ ক্যান্সারগুলো বেশি দেখা যায়। এছাড়া যারা রেডমিট যেমন গরু বা খাসির মাংস বেশি খাচ্ছেন এবং ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার যেমন শাক-সবজি কম খাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে মলদ্বারের ক্যান্সার বেশি হচ্ছে।
লজ্জা, সংকোচ, ভয় আর অবহেলার কারণে আক্রান্তরা অনেক দেরিতে বা তৃতীয় বা চতুর্থ ধাপে গিয়ে আমাদের কাছে আসছেন। ক্যান্সার সম্পর্কে সবসময় একটা স্লোগান আমরা দিয়ে থাকি, সূচনায় যদি ক্যান্সার রোগটা ধরা যায় তাহলে এটা পরিপূর্ণ নিরাময়যোগ্য। কারণ উন্নত বিশ্বে যা যা চিকিৎসা আছে এর সব আমাদের দেশে সহজলভ্য। শুধু আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে এবং রোগটিকে আগে আগে চিহ্নিত করা গেলে, ক্যান্সারে মৃত্যুর হার উন্নত দেশের মতোই অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার সাধারণত নিম্নবিত্ত নারীদের বেশি হচ্ছে এবং অ্যান্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার বলি যেটা জরায়ুর ঠিক ওপরের ভাগে ইউটেরাস হয়, সেই ক্যান্সারটা উচ্চবিত্তদের বেশি হচ্ছে। আর ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারটা সোশিও-ইকোনমিক কন্ডিশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না। এর কিছু জেনেটিক ফ্যাক্টর আছে। জরায়ু বা ব্রেস্ট ক্যান্সার যেমন খুব তাড়াতাড়ি লক্ষণ প্রকাশ করে ওভারিয়ান ক্যান্সার হলে এত সহজে ধরা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের যেসব লক্ষণ থাকে সেগুলো উপেক্ষা করার মতো এবং এগুলো অন্য যেসব জিআইটি সমস্যাগুলো যেমন গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার সঙ্গে খুব ওভারল্যাপ করে দেখে প্রাথমিক পর্যায়ে বোঝা যায় না। এর জন্য খুব দেরিতে রোগটা শনাক্ত করা হয়। ফলে দেখা যায় অনেকে তৃতীয় স্টেজ বা চতুর্থ স্টেজে আমাদের কাছে আসে। সে সময়ে সেই অবস্থায় চিকিৎসা দিতে হয় কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল মেলে না।