চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি দায় কমানোর তোড়জোড় শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার শর্তও কঠোর করা হয়েছিল। আবার ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল দেশের অনেক ব্যাংক। এতে আমদানির নতুন এলসি খোলা কমেছে। তবে ব্যাপক কড়াকড়ি সত্ত্বেও দেশের আমদানি নিষ্পত্তি কমানো সম্ভব হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের আমদানি নিষ্পত্তি ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। অর্থমূল্যে এ নিষ্পত্তি বাড়ার পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে জ্বালানি ও ভোজ্যতেল এবং বস্ত্র খাতের মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব।
২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে টালমাটাল পরিস্থিতি পার করেছে বাংলাদেশ। রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানি করতে গিয়ে বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ওই সময় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল বাংলাদেশের বিওপি। ডলারের বাজারে তীব্র সংকট তৈরি হওয়ায় আমদানি কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশের আমদানির এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৪১ কোটি বা ৩৮ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। এ হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় এবার প্রথম ছয় মাসে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি ২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এলসি নিষ্পত্তি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।
তবে গত অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমদানির নতুন এলসি ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে নতুন এলসির পরিমাণ ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৩৪ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এ হিসাবে নতুন এলসির পরিমাণ ৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
আমদানির নতুন এলসির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারাকে সফলতা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি এলসির লাগাম টেনে ধরতে পারাটি প্রাথমিক সফলতা। গত জুলাই থেকে আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আগে খোলা এলসি গত ছয় মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে। এ কারণে এলসি নিষ্পত্তি এখনো কমানো সম্ভব হয়নি। আশা করছি, দুই-তিন মাসের মধ্যে এলসি নিষ্পত্তিও কমে আসবে। তখন ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় আছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি পরিস্থিতির উন্নতিও এখন দৃশ্যমান।’
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে। নতুন এলসি ৪৪ শতাংশ কমেছে বিদেশী ফল আমদানির। পাশাপাশি চিনি ও লবণ আমদানির নতুন এলসি কমেছে ৩৫ শতাংশের বেশি। তবে ভোজ্যতেল, চাল, গম, ডাল, মসলাসহ কিছু ভোগ্যপণ্যের নতুন এলসি বেড়েছে। সব মিলিয়ে ভোগ্যপণ্যের নতুন এলসি খোলা কমেছে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। একই সঙ্গে এসব পণ্যের এলসি নিষ্পত্তিও ৯ শতাংশের বেশি কমেছে।
আমদানি নতুন এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে শিল্পের মধ্যবর্তী (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) পণ্যের। এক্ষেত্রে নতুন এলসি খোলা কমেছে ৩৩ শতাংশেরও বেশি, নিষ্পত্তি কমেছে ১৭ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির নতুন এলসি কমেছে ২৭ শতাংশ। তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি নতুন এলসি কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির। এক্ষেত্রে এলসি খোলার হার ৬৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে। অন্যান্য শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নতুন এলসি ৪২ শতাংশ কমেছে। তবে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি দুটিই যথাক্রমে ৭৬ ও ১০৪ শতাংশ বেড়েছে। এক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক কমেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির এলসি। গত ছয় মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪৯ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমলেও লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিওপির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার বা ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ ঘাটতি ৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশকের বড় ঘাটতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে আরো বেশি চাপে ফেলেছে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।