নারীবাদ ও নারী শিল্পী

নারীবাদের আবির্ভাবের আগেই প্রকৃতির মাঝে সম্পূর্ণা নারীর আবির্ভাব। ধারণাতীতকাল থেকে সে পূজিত। নারীর শক্তি, গরিমা পৃথিবীর বেশির ভাগ কৌম সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

নারীবাদের আবির্ভাবের আগেই প্রকৃতির মাঝে সম্পূর্ণা নারীর আবির্ভাব। ধারণাতীতকাল থেকে সে পূজিত। নারীর শক্তি, গরিমা পৃথিবীর বেশির ভাগ কৌম সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরিবার, সংগঠন, পুনরুৎপাদন, জীবিকার প্রশ্নে নারী অগ্রভাগে। এর সাক্ষী প্রাচীন শিল্পকর্ম। সময়ের বাঁকবদলে নারীবাদে পুনরুত্থান ঘটেছে জগেক দেখার নতুন বীক্ষা হিসেবে। এটা ঠিক যে নারী-পুরুষ বিভাজনের বাইরে মানুষ হিসেবে সমাজ সৃজন করতে চাই আমরা। কিন্তু নারীকে নারী হয়ে কথার প্রেক্ষাপটটা বোঝা দরকার। যখন নতুন করে সমানাধিকার, কথা বলার অধিকার নিয়ে সোচ্চার, নারী তখন তার মনোজগেক খুলে দেয় শিল্পের রূপ-রসে।

আশির দশকের আগে পরে বাংলাদেশের চিত্রকলাজগতে নারী শিল্পীদের উপস্থিতির ধারাবাহিকতা ধারণ করেই নির্মিত হয়েছে চিত্র শিল্পে নারীর একান্ত ভাষা; যে ভাষায় আছে নারীবাদ, নারীর অবস্থান, মহিমা, স্বতন্ত্রতা, সৃজন আর প্রথা ভাঙার কথাও। নারী শিল্পীদের আলাপচারিতায় প্রথমেই আসে নাজলী লায়লা মনসুর, ফরিদা জামান, রোকেয়া সুলতানা, দিলারা বেগম জলির নাম। এর পরের পর্যায়ে আসেন আতিয়া ইসলাম অ্যানি, নীলুফার চামান, কনক চাঁপা চাকমা, তৈয়বা বেগম লিপি। নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার কাজে হদিস মেলে নারীবাদী অভিব্যক্তির।

শিল্পের নিজস্ব ভাষা ধারণ করেই নারী শিল্পীরা ভাবনা ব্যক্ত করেছেন তাদের স্বতন্ত্র সব ক্যানভাসে। শিল্পী নাজলী লায়লা মনসুরের ছবিতে অনেক মানুষের প্রতিকৃতি দেখা যায়। খুঁজে পাওয়া যায় প্রত্যেকটা মানুষের একাকিত্ব স্বতন্ত্রতাকে। তার হাসি-আনন্দের ভেতরেও কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বিষাদ নিঃসঙ্গতার ছায়া আছে। ওই বিচ্ছিন্নতা আর বিষাদ যেন তার ছবির অন্তর্নিহিত বোধ। নারীবাদী অনুষঙ্গ তার চিত্রকর্মে সার্বিক সমাজ পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবেই আমরা দেখতে পাই।

শিল্পী ফরিদা জামানের চিত্রভাষা খুব সহজ সাবলীল। আমাদের প্রাত্যহিক দেখার জগৎ তার চিত্রভাষায় পেয়েছে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। তার রঙ মুগ্ধতা সৃষ্টি করে। সে বৈশিষ্ট্যও শান্ত-সাধারণ। প্রতিদিনকার পরিচিত পরিবেশ তার চিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। তার কাজে দেশের মানুষ প্রাণ-প্রকৃতিকে অনুভব করা যায় খুব সহজেই।

বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় উজ্জ্বল উপস্থিতি চিত্রশিল্পী রোকেয়া সুলতানার। নারী শিল্পী পুরুষ শিল্পী বিভেদরেখা তিনি সমর্থন করেন না। তার মতে, শিল্পীসত্তার নারী-পুরুষ বিভেদ আমি বিশ্বাস করি না। শিল্পী শিল্পীই। যারা নারী নিয়ে কাজ করেন, হয়তো সেই বিষয় দ্বারা তারা ইনফ্লুয়েন্সড! এটা হতেই পারে। বিষয়ভিত্তিকতার জন্য শিল্পীসত্তার বিভেদীকরণটা আমি ঠিক মনে করি না; বরং এটা সম্পৃক্তকরণই স্বাভাবিক বলে মনে করি। তবে শিল্পীর কাছে নারী খুব শক্তিশালী সত্তা। নারীর ইতিবাচক শক্তি তাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে। নারী-পুরুষের বিভাজনের বিতর্ক নয়, মানুষ হিসেবে সবার সম্মান অধিকারের সমতার প্লাটফর্মটা খুব জরুরি, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ভারসাম্যের বিষয়, জীবনের এক অন্যতম নন্দিত দর্শন। (রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনীর নেয়া সাক্ষাৎকার থেকে) শিল্পী নীলুফার চামানের শিল্প সৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া যায় অদৃশ্য সামাজিক দায়িত্ববোধের ভিন্ন এক চিত্রভাষা। শিল্পী তার তুলির গল্পের মধ্য দিয়ে সমাজকে সুন্দর সুশীল করে ভুলে যাওয়া মানবিক অনুভূতির কথা মনে করিয়ে দেন।

কনক চাঁপা চাকমার কাজগুলো মনোযোগ নিবদ্ধ করে নারী জীবনের ওপর। তার কাজে ফুটে ওঠে পাহাড়ের নিসর্গ, নর-নারীর দেহভঙ্গিমা, অসহায় মানুষের জীবনযাত্রা, ক্ষুধার্তদের আর্তনাদ। উজ্জ্বল রঙ, মোটা রেখা, দেহজ সাবলীল দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া অবয়ব ক্যানভাসজুড়ে রাঙিয়ে তোলেন। এখানেই যেন তার শিল্পসত্তার সার্থকতা তৈরি হয়। তৈয়বা বেগম লিপির কাজের প্রতিটি ধাপে আছে একটি করে নতুন গল্প। তার ব্লেড সিরিজের কাজের অভিনবত্ব চোখে পড়ার মতো, যা মনে করিয়ে দেয় প্রথাগত পুরনো গল্পগুলোকে। শিল্পীর কাজ আলোড়ন তোলে মননে-মগজে। বিষণ্নতা, একাকিত্ব আর নারীর বন্দিদশাও তার কাজে ছায়া হয়ে ফুটে ওঠে। নানা মাধ্যমে কাজ করেন তিনি। চিত্রকর্ম, স্থাপনা, ভিডিও ইনস্টলেশনের মতো মাধ্যমগুলো দিয়ে প্রকাশ করেন তার স্বশিল্পভাবনাকে। বিশ্বের বিভিন্ন আর্ট ইভেন্টে জায়গা করে নিয়েছেন শিল্পী তার কাজের মাধ্যমে।

হিসেবে নারীবাদ বলে একাট্টা বাংলাদেশের চিত্র শিল্পে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধেনি। বরং সময় সমাজের প্রয়োজনে নারীসত্তাকে উদযাপনের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে তাদের রঙ-তুলি। অন্তর্জগৎ থেকে তারা এমন এক সমাজ দেখেছেন, যেখানে অনুচ্চভাবে রয়ে গেছে তাদের কথা। অনুভবটুকু শুধু পুরুষ বা মানুষ আকারে দেখা সম্ভব নয়। সেই ভাবনাগুলোয় নারীর শক্তির যে উত্থান তা আমাদের সামগ্রিক যাত্রাকে মসৃণ করেছে। আর নারীর সামনে ভাবনা দেখার নতুন উৎসমুখ খুলে দিয়েছে।

আরও