আলোকপাত

২০২২ সালের অর্থনীতিতে নোবেল জয় ও দেশের ব্যাংক খাতের দাওয়াইপত্র

‘ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের সংকটের ওপর গবেষণা’র জন্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেন এস বার্নান, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগকে যৌথভাবে ২০২২ সালের অর্থনীতির ওপর নোবেল পুরস্কার দিয়েছে। ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতি শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার চালুর পর অত্যাসন্ন কোনো অর্থনৈতিক সংকটের ঠিক আগে আগে,

ব্যাংকিং আর্থিক খাতের সংকটের ওপর গবেষণা জন্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেন এস বার্নান, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ফিলিপ এইচ ডিবভিগকে যৌথভাবে ২০২২ সালের অর্থনীতির ওপর নোবেল পুরস্কার দিয়েছে। ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতি শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার চালুর পর অত্যাসন্ন কোনো অর্থনৈতিক সংকটের ঠিক আগে আগে, তা নিরসনে তাত্ত্বিক প্রায়োগিক মডেলের মাধ্যমে উপায় বাতলে দিয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো কাকতালীয় ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। নোবেল কমিটি এবারের পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণ তুলে ধরে বলেছে, ব্যাংকবিষয়ক আধুনিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সংকটের সময় ব্যাংক ব্যবস্থা কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হয়। আবার ব্যাংক ধসে পড়লে কীভাবে আর্থিক সংকট ঘনীভূত হয়। তিন অর্থনীতিবিদ আশির দশক থেকেই কীভাবে ব্যাংক কাজ করে, ভুল করে, ঝুঁকি সংকট তৈরি করে, কীভাবে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয় এবং সংকট সমাধানে সফল হতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা করেছেন। এদের বেশির ভাগ কাজই সর্বোচ্চ পঠিত এবং প্রভাবশালী গবেষণাপত্র হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। নোবেল কমিটি বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক অর্থনীতিবিদ কভিড-১৯ অভিঘাত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে চরম অস্থিতিশীল বিশ্ব অর্থনীতির সামনে ২০২৩-২৪ সময়কালে অর্থনৈতিক মন্দার যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তাতে বিশ্বের ব্যাংক এবং আর্থিক খাত যেভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে বার্নান, ডায়মন্ড ডিবভিগের গবেষণাগুলো বিশেষভাবে কাজে লাগবে বলে মনে করছেন। ধনী বা উন্নত দেশগুলো ছাড়াও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের দুর্বল সংকটপূর্ণ ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিকদাওয়াইপত্র হতে পারে তিন অর্থনীতিবিদের ব্যাংকের মূলধন, আমানত ঋণসহ নানা তত্ত্ব, তথ্য বিশ্লেষণগুলো। কেননা বাংকের অত্যাবশ্যকীয় সব অনুষঙ্গে সংকট ঝুঁকির সব উপাদানই বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে জোরালোভাবে বিদ্যমান। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে দেশের ছয়টি সরকারি ছয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে, যাদের মধ্যে নতুন প্রজন্মের বেঙ্গল ব্যাংকও রয়েছে। এরা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি মূলধন ঘাটতির কারণে। গত জুন শেষে আলোচ্য এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৩১ কোটি টাকা। দেশে ঋণখেলাপির পরিমাণও দৃষ্টিকটু রকমভাবে বেশি লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। বিশ্বের সব দেশেই ব্যাংক খাতে এখন সংকট চলছে, কিন্তু অর্থনীতির পরিধি অনুপাতে কোনো দেশের একসঙ্গে ১২টি ব্যাংকের ধরনের মূলধন ঘাটতি অথবা এত বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণসহ একসঙ্গে নানা সংকটের নজির খুব কম দেশের ব্যাংক খাতে রয়েছে। এবারের নোবেল পুরস্কার নিঃসন্দেহে তাই বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনার জন্য বড় এক সহায়তার বার্তা বহন করে এনেছে।

তিনজন নোবেলজয়ীর মধ্যে ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ফিলিপ এইচ ডিবভিগতাদের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যাংগুলো অর্থনীতিতে তারল্য তৈরি করে এবং তারল্য আমানত বীমা বা অন্যান্য সুরক্ষা জালের অভাবে গ্রাহকের আকস্মিক, আতঙ্কিতভাবে সঞ্চয় উত্তোলনের পথে প্ররোচিত করে।ডায়মন্ড-ডিবভিগ মডেল’-এর মাধ্যমে তারা দেখিয়েছেন, ব্যবসায়িক ঋণের অর্থায়নে ব্যবহূত আমানত পরিস্থিতি অস্থির হতে পারে, ব্যাংকের তারল্য সংকট বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ব্যাংক কীভাবে সমস্যার সেরা সমাধানও দিতে পারে। তারা বলছেন, প্রকৃত অর্থে ব্যাংক সঞ্চয়কারী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সঞ্চয়কারীদের যেমন তাত্ক্ষণিকভাবে সঞ্চয় ভাঙার সুযোগ দেয়, তেমনি ঋণগ্রহীতাদেরও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, কিন্তু ব্যাংক যে এভাবে দুই পক্ষকে সেবা দেয়, তাতে ব্যাংক নিয়ে ব্যাংক আমানতকারীদের মনে এক ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ কাজ করে। সংকট দেখা দিলে ব্যাংকের মূলধন জোগানো আমানতকারীরা মনে করেন, তার সঞ্চয় হয়তো ঋণখেলাপিরা খেয়ে ফেলবেন। কারণে যখন অর্থনীতি নিয়ে গুজব সৃষ্টি হয়, তখন ব্যাংকের আমানত পরিস্থিতি ধসে পড়তে দেখা যায়। বিপুলসংখ্যক সঞ্চয়কারী তখন একসঙ্গে সঞ্চয় ভাঙার জন্য ব্যাংকে যান এবং গুজবকে বাস্তব রূপদানের কাছাকাছি নিয়ে যান। তবে বিপজ্জনক পরিস্থিতি আগে থেকে এড়াতে সরকার উদ্ধারকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে ঋণের বিপরীতে বীমা প্রদানের সুরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এমনিতে সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের জন্য আপত্কালীনভাবে অর্থ সরবরাহ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু আগে সৃষ্টি না করা সুরক্ষা জালের অভাবে অনেক সময় সরকারের সরবরাহকৃত অর্থ আর ফেরত পাওয়া সম্ভব হয় না। ডগলাস ডায়মন্ড তার গবেষণায় বলেছেন, ব্যাংক তারল্যও আমানতের ঝুঁকি এড়াতে পারে সঞ্চয়কারী আমানতকারীর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে এবং ঋণগ্রহীতার ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা নিরূপণে ব্যাংকের সুবিধাজনক অবস্থানকে সত্ভাবে কার্যকর করে। কারণ প্রদানকৃত ঋণ যাতে ভালো প্রকৃত খাতে বিনিয়োগ হয়, তা নিশ্চিত করা ব্যাংকের কর্তব্য। অন্যদিকে বেন এস বার্নানকে আধুনিককালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দা নিয়ে গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক আমানতকারী একসঙ্গে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেয়ার কারণে ১৯৩০-এর মহামন্দা কীভাবে অর্থনৈতিক সংকটকে গভীর দীর্ঘস্থায়ী করেছিল। দেউলিয়া হওয়া ব্যাংকগুলো থেকে একসঙ্গে হাজারো ঋণগ্রহীতার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হারিয়ে যাওয়ায় অনেক ঋণ আর পুনরুদ্ধারও করা যায়নি। ফলে আমানতকারীদের সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তরের সক্ষমতা ব্যাপক ব্যাহত হওয়ায় অর্থনীতির সব অঙ্গনই চরম সংকটে পতিত হয়েছিল এবং ব্যাংক নিয়ে তীব্র আস্থার সংকট দেখা দিয়েছিল।

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান টোরি এলিংসন বলেছেন, ‘আর্থিক সংকটের মধ্যে মানব সমাজে ব্যাংকের ভূমিকা কী হওয়া উচিততা নিয়ে পুরস্কারজয়ীদের কাছ থেকে পাওয়া গভীর অন্তর্দৃষ্টি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট এবং বিশাল ব্যয়বহুল ত্রাণ প্যাকেজের (বেইলআউট) হাত থেকে বাঁচার ক্ষমতাকে উন্নত করেছে। বেইলআউট এড়ানোর পথ বাতলে দিয়ে এবং আর্থিক খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে তাদের গভীর বিশ্লেষণ অনেক বেশি বাস্তবমুখী, যা ব্যাংক ব্যবস্থার সম্ভাব্য ধস ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তারা ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আমানতকারীদের আস্থার সংকট, ঋণ মঞ্জুর করার ব্যাপারে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব, ব্যাংকের তারল্য মূলধন ঘাটতির বিষয়ে সতর্কতা, সংকটাপন্ন ব্যাংককে রক্ষা করতে আমানতের ওপর যথেষ্ট অংকের বীমার ব্যবস্থা করা এবং সরকারের অসতর্কতা গাফিলতির কারণে খেসারত হিসেবে পরবর্তী সময় দেউলিয়া ব্যাংককে বাঁচাতে বড় অংকের বেইলআউট বোঝা বহন নিয়ে যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা নিশ্চিতভাবে যেকোনো অর্থনীতির সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

নোবেল কমিটির উত্থাপিত বিবেচিত উল্লেখিত বিষয়গুলো বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নোবেল কমিটির বিবেচনায় নেয়া সব ব্যাংকিং উপাদানেই সংকটের উপস্থিতি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় আছে, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে যেকোনো ব্যাংককে কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে, যার কম হলেই মূলধন ঘাটতি হিসেবে পরিগণিত হবে। আইনে আরো বলা আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মেনে নেবে। দুই বছরের পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে হবে, অথবা বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি নিয়ে সব তথ্য হাতে থাকলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে ২৯ হাজার ৩১ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে থাকা ১২ ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের হাজার ৬০৩ কোটি, রূপালী ব্যাংকের হাজার ২৬১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের হাজার ৫০৭ কোটি, বেসিক ব্যাংকের হাজার ১২৪ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৩ হাজার ১৭১ কোটি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের হাজার ১৪৯ কোটি টাকা রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের হাজার ২৭৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২৯৯ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ২৬৩ কোটি এবং নতুন প্রজন্মের বেঙ্গল ব্যাংকের কোটি ৩০ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাংকের অধিকাংশেই অনেক বছর মূলধনের বিপুল ঘাটতি চলছে, যা মূলত তৈরি হয়েছে অনেকটা গেঁড়ে বসা ঋণখেলাপি সংস্কৃতির সুযোগে মাত্রাতিরিক্ত মন্দ ঋণের কারণে। বাংলাদেশে সাধারণত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রদত্ত ঋণকে সম্পদ বা মূলধন হিসেবে বিবেচনা করে। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ব্যাংকের লোকজনের যৌথ চক্রের যোগসাজশে ঋণ নামের সম্পদ লুটে নিচ্ছে গুটি কয়েক লোক। এমনকি ব্যাংকের বড় অংকের ঋণ নিয়ে তা মেরে দিতে অনেকে আবার ব্যাংকের রক্ষক হিসেবেও আসীন হন এবং নির্দ্বিধায় ভক্ষক হয়ে যান। শক্তিশালী অনেক বিধান থাকলেও দুষ্ট চক্রের দোর্দণ্ড প্রভাব-প্রতিপত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আজ পর্যন্ত অপসংস্কৃতি বন্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তবে যখন বড় অংকের ঋণ নিয়ে কেউ বিদেশে পালিয়ে যান, তখন শুরু হয় তাদের তত্পরতা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে আমানতকারীরা সেই টাকা ফেরত না পেয়ে আত্মহত্যাও করেছেন। আমানতকারীদের কোটি কোটি টাকা সঞ্চয়ের বিপরীতে লাখ টাকা বীমার বিধান হাস্যকর বলে অনেক অর্থনীতিবিদ বলে এলেও তা কখনোই গুরুত্ব পায়নি। অথচ এবারের নোবেল পুরস্কারের অন্যতম বিষয়ই হচ্ছে, আমানতের বিপরীতে বীমার সুরক্ষা বিস্তৃত করা এবং বেইলআউটের বোঝা বহন না করতে সরকারকে আগেই সতর্ক হতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং এযাবত্কালের সর্বোচ্চ। তবে অবলোপন, ছাড় রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় ঋণের পুনর্গঠন বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি হবে। এবারের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদরা হাতে-কলমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে শুধু ব্যবসাই ব্যাংকের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়, কারণ আমানতকারীদের সঞ্চয় উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিকে ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা এবং সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করা ব্যাংকের কর্তব্য। এতে করে ব্যাংক, আমানতকারী ঋণগ্রহণকারীসবার সমৃদ্ধিই যুগপত্ভাবে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। একসঙ্গে অনেক ব্যাংকের মূলধন সংকটে পড়া, ঋণভারে জর্জরিত দেউলিয়া হওয়া এবং সবশেষে সরকারের ব্যয়বহুল বেইলআউট কর্মসূচি দিয়ে সমস্যা সমাধান এগিয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করে। সরকার সময়মতো সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ নিলে অর্থনীতির সংকট সহজেই এড়াতে পারে।

২০২২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানে নোবেল কমিটির কাছে বিবেচিত হওয়া ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থার সংকট, ঋণ প্রদানে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় অসংগতি, অমানতের ওপর যথেষ্ট অংকের বীমার ব্যবস্থা না করা, ব্যাংকের তারল্য মূলধন ঘাটতি, সংকটাপন্ন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান উদ্ধারে সরকারের বেইলআউট কর্মসূচি এবং সরকার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অসতর্কতা গাফিলতিসহ প্রতিটি মানদণ্ডই বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য প্রযোজ্য। পুরস্কারপ্রাপ্তরা গত ৪০ বছর তাদের গবেষণায় অনুসন্ধান করেছেনব্যাংকগুলো কী করে, কেন করে এবং তাদের কৃতকর্মের পরিণতি কী হয়েছে তা কার্যকারণসহ ব্যাখ্যা সর্বোপরি আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডগলাস ডায়মন্ড গবেষণা করেছেন কীভাবে ব্যাংক তাদের ঋণগ্রহীতাদের যাচাই-বাছাই করে, সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ফিলিপ ডিবভিগ ব্যাংকের গতিশীলতা নিয়ে মডেল তৈরিতে সাহায্য করেছেন, বেন এস বার্নানকে অধ্যাপনার পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনজনই বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থনীতি শাস্ত্রে পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন। এদের মধ্যে ফিলিপ ডিবভিগ আবার গণিত, পদার্থবিদ্যায় স্নাতক অর্জনের পর ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট অর্জন করে সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে পড়ানো শুরু করেন। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাংক খাত নিয়ে ত্রি-রত্নের ব্যাপক-বিস্তৃত জ্ঞান রয়েছে। তাদের তত্ত্ব, তথ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সবকিছুই তারা ৪০ বছর ধরে অবলোকন করেছেন। কাজেই বিশ্বের আর সব দেশের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশেরযেখানে ১০ জন শীর্ষ ঋণগ্রহীতা একসঙ্গে তাদের ঋণ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানালে ৩৭টি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে এবং অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে, সেখানে ষাটোর্ধ্ব এবারের তিন নোবেলজয়ীর জ্ঞান কাজের স্বীকৃতি বাংলাদেশের সংকট জর্জরিত ব্যাংক খাত তথা অর্থনীতির জন্য নিশ্চিতভাবেই উত্কৃষ্ট দাওয়াই হতে পারে।

 

. আইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি

আরও