পণ্যবাজারের অস্থিরতা কমানো এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ বা ‘ফিউচার্স মার্কেট’। সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে এ বছরের মধ্যেই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করা। এজন্য এরই মধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতের এমসিএক্সের চুক্তিও হয়েছে। প্রথমদিকে এ মার্কেটে সোনা, ক্রুড অয়েল ও কটনের কেনাবেচা হবে। তবে পরিপূর্ণ ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ প্রতিষ্ঠায় অন্তত পাঁচ বছর লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় খাদ্যে ভেজালসহ আট চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়ন অগ্রগতি শীর্ষক প্রতিবেদন সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিএসইসি। ওই প্রতিবেদনে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়। বিএসইসি বলছে, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। কারণ এক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফর্মে পণ্য না দেখেই পণ্য বেচাকেনা হবে। এতে ভালো পণ্য সরবরাহ করার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ অবকাঠামোর ভঙ্গুর অবস্থা, ঝুঁকি হ্রাসের যথাযথ ইন্সট্রুমেন্টের অভাব, এ বিষয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই জ্ঞানের অভাব এছাড়া উভয়ের মূলধনের অভাবকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের অভাব, ফসল ফলানোর পর শেষ পর্যায়ে এসে নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং অসম্পূর্ণ বাজার ব্যবস্থাকেও কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়েছে।
অগ্রগতির বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বা সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করা হবে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন সিএসইকে কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাথমিকবাবে সম্মতি দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের (এমসিএক্স) মধ্যে এরই মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এদিকে সিএসই সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে তারা দুই-তিনটি পণ্য দিয়ে এ বছরের মধ্যে এক্সচেঞ্জটি চালু করতে চায়। তবে একটি পরিপূর্ণ কমোডিটি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে বছর পাঁচেকের মতো সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন সিএসই কর্মকর্তারা।
বিএসইসি বলছে, পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, যথাযথ মূল্য নির্ধারণ, একচেটিয়া ব্যবসা হ্রাস, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা, পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং প্রান্তিক কৃষকের যথাসময়ে অর্থায়নসহ অন্যান্য কার্যক্রম কমোডিটি এক্সচেঞ্জের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রুলস, ২০২০ অনুযায়ী কমিশন কমোডিটি এক্সচেঞ্জের অনুমোদন এবং এর বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করবে। অনুমোদিত স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়ার সুযোগ নেই বলেও জানিয়ে দেয় বিএসইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ খুবই প্রয়োজন। এটি আরো আগেই বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন ছিল। এক্সচেঞ্জটি চালু করতে কোনো চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা হলে সেটি সমাধানের জন্য কমিশন সার্বিক সহযোগিতা করবে। একসঙ্গে অনেক পণ্য না এনে পর্যায়ক্রমে আনা হলে এক্ষেত্রে সুবিধা হবে বলে মত দেন তিনি।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ অনুযায়ী, কৃষিপণ্য, গবাদিপশু, মাছ, বনজ সম্পদ, খনিজ ও জ্বালানি পণ্যসহ উৎপাদিত যেকোনো পণ্য কমোডিটি এক্সচেঞ্জের আওতায় কেনাবেচা করা যাবে। এসব পণ্য কেনাবেচা বা লেনদেনের উদ্দেশ্যে যে এক্সচেঞ্জ বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, সেটিই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নামে পরিচিত হবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ, ব্রোকার এবং মেম্বার পার্টিসিপেন্টদের লাইসেন্স প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য এ-সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে বলেও জানানো হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রয়োজনীয় খসড়া বিধিবিধান প্রণয়নের জন্য চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ভারতের এমসিএক্স কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদন ও প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত বিধিবিধানের অনুমোদন পরবর্তী সময়ে দেয়া হবে।
মার্কেট প্লেয়ারদের ভূমিকা ও জবাবদিহিতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। কমোডিটি বা পণ্য সংরক্ষণ, গুদামজাত ও হস্তান্তরের জন্য নিবন্ধিত ওয়্যারহাউজ সুবিধা এবং নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। উপযুক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মার্কেট অংশীদারদের সচেতনতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত কার্যক্রম চালাতে হবে। ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য মূল্য নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া সামগ্রিক ঝুঁকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য কমোডিটি সম্পর্কে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে।
বিএসইসি বলছে, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় বেশকিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও কমিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। এছাড়া কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, যথাযথ মূল্য নির্ধারণ, একচেটিয়া ব্যবসা হ্রাস, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করে পণ্যবাজার ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষি অর্থায়নের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।
জানা গেছে, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ অনেকটা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার কেনাবেচার মতো। স্টক এক্সচেঞ্জের মতো কোম্পানি শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করে, ঠিক একইভাবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জে শেয়ার নয়, পণ্য কেনাবেচা হয়। তবে এ পণ্য কেনাবেচা সাধারণ পাইকারি বাজারের মতো নয়। মোকামে ক্রেতা-বিক্রেতা দরদাম করে পণ্য কেনাবেচা করেন। কিন্তু কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ক্রেতা-বিক্রেতা সরাসরি পণ্য কেনাবেচার সুযোগ নেই। অনেকটা শেয়ারের মতো বিক্রেতার দেয়া পণ্যের সার্টিফিকেট বিক্রি হয়। শেয়ারবাজারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জেও নির্দিষ্ট ও অনুমোদিত ব্রোকারের মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করতে হয়। নিজের বা প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। সবকিছুই শেয়ারবাজারের মতো। তবে এ বাজারে পণ্য কিনে তা ডেলিভারি না নিয়ে ক্রয়কৃত সার্টিফিকেট অন্য কারো কাছে বিক্রি করা হয়। অনেকটা মিলগেটে অর্ডার বা ডিও কেনাবেচার মতো।
ধরা যাক, কমোডিটি এক্সচেঞ্জে আলু কেনাবেচা হলো। সরাসরি কৃষক বা হিমাগারের মালিক, যার মালিকানায় পণ্যটি রয়েছে, তিনি এই আলু বিক্রি করতে পারবেন। আর কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যে কেউ এ আলু কিনতে পারবেন। আইনের মাধ্যমে এ আলু কেনাবেচার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত একটি সময় বেঁধে দেয়া হবে। ওই সময় ক্রয়াদেশটি যার হাতে থাকবে, তাকে বিক্রীত ওই আলু বুঝিয়ে দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালসহ আসিয়ানভুক্ত বিভিন্ন দেশ ও উন্নত বিশ্বে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ অনেকদিন ধরেই রয়েছে এবং সেগুলো ভালোভাবেই পারফর্ম করছে। বাংলাদেশেও একটি পরিপূর্ণ কমোডিটি কাঠামো গড়ে তুলতে চায় সরকার, যেখানে ফিউচার কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কৃষি, শিল্প কিংবা ভোগ্যপণ্যভিত্তিক কমোডিটি পণ্য বেচাকেনা করার সুবিধা থাকবে। এটি স্টক এক্সচেঞ্জেরই একটি ভিন্ন রূপ হবে, যেখানে পণ্য লেনদেন হবে।