গত বছরের ১ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে ভারত, চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার সব দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়নের হার ছিল বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের চেয়ে কম অবমূল্যায়ন হয়েছে শুধু কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। শ্রীলংকা, তুরস্কের মতো দেশগুলোয় অবমূল্যায়নের হিসাব সিলেবাসেরও বাইরে। চলতি বছর বিশ্বব্যাপী ডলার শক্তিশালী হয়েছে। বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশেও ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে যাতে কোনো ধরনের সংকট না হয়, সেটি আমরা নিশ্চিত করব, দেখব এবং পদক্ষেপ নেব।
বণিক বার্তা ও বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এনবিএফআই মেলা-২০২২-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এসব কথা বলেন। রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল দিনব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিমুখী। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। বিশেষ করে কার্ব মার্কেটে তা অনেক বেশি। আমাদের দেখতে হবে, কার্ব মার্কেটের ডলারের ব্যবহারকারী কে? কার্ব মার্কেটের ডলারের ব্যবহারকারী দেশের ১৭ কোটি মানুষ নয়। খুব সীমিতসংখ্যক মানুষ কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কেনেন। বিশেষ করে যারা বিদেশ ভ্রমণে যাবেন বা বিদেশে কারো কাছে ডলার পাঠাবেন এমন মানুষেরাই এ বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করেন।
ব্যাংকগুলোর ঋণপত্রের দায় পরিশোধের ক্ষেত্রেও এ মুহূর্তে ডলারের বিনিময় হার কিছুটা বেশি বলে স্বীকার করেছেন গভর্নর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে এর চেয়েও বেশিতে। তবে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের এলসি পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় সব ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির দায় পরিশোধের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আংশিক সহযোগিতা করছে। বাদ থাকে শুধু অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির এলসি দায়। এ পরিস্থিতিতে ডলার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ফজলে কবির বলেন, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) পেমেন্ট করার পর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছিল। বর্তমানে এটি আবারো ৪২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রিজার্ভের পরিমাণ আগামীতে আরো বাড়বে। অগ্রাধিকার পণ্যের আমদানি দায় পরিশোধের জন্য এখন পর্যন্ত আমরা রিজার্ভ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার জোগান দিয়েছি। সাধারণ মানুষের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখতে বাজারে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে।
সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান এবং আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মমিনুল ইসলাম, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. জামাল উদ্দিন এবং বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ইফতেখার আলী খান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশে এনবিএফআই খাতের বয়স চল্লিশ বছর। এত দীর্ঘ সময় পর খাতটি নিয়ে একটি মেলার আয়োজন হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো এ মেলার আয়োজন করায় বণিক বার্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ। মেলায় যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন।
এ সময় ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করছে বলে মন্তব্য করেন ফজলে কবির। তিনি বলেন, এ কারণে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। এ অসামঞ্জস্যতা দূর করতেই জন্ম হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। অবকাঠামো, গৃহঋণসহ বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ জোগানোর জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হলো এনবিএফআইগুলোও তিন মাস মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। তিন মাস মেয়াদি আমানত দিয়ে যদি ১০-১২ বছরের জন্য ঋণ দেয়া হয়, তাহলে সংকট থেকেই যাবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এনবিএফআইগুলোকে অনেক বেশি বিশেষায়িত হওয়ার পরামর্শ দেন গভর্নর। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গৃহঋণসহ গুটিকয়েক ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল। কুটির, ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। উৎপাদনমুখী সিএসএমই খাতে ঋণ বেশি দিয়ে ট্রেড ফাইন্যান্সিং নিয়ন্ত্রিত রাখা গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।
ক্ষুদ্র ও ছোট ঋণের আদায় অনেক ভালো বলে মন্তব্য করেন ফজলে কবির। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটরা ঋণ নিলে সেটি তাদের মাথাব্যথা হয়, আর বড়দের ঋণ দিলে সেটি ব্যাংকারের মাথাব্যথা তৈরি করে। অর্থনীতিবিদ কেইনসের বক্তব্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমার প্রত্যাশা, এনবিএফআইগুলো সিএসএমই খাতে বেশি ঋণ দেবে।’ করোনাসৃষ্ট দুর্যোগের সময় সম্মুখ যোদ্ধার ভূমিকা রাখায় গভর্নর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাধুবাদ জানান।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বিএলএফসিএ চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করছি। আমরা সবুজ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছি। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এর সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কিছু পণ্য বা সেবা বাংলাদেশের বাজারে সরবরাহ করছি। যেগুলো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, আমাদের যখন ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন একটু সাবস্ট্যান্ডার্ড হিসেবে দেখা হয় অথবা আমরা নিজেরাও দেখে থাকি। কিন্তু ছোট মানেই খারাপ নয়, সাবস্ট্যান্ডার্ড নয়। আমরা ছোট হয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি এ দেশের মানুষের জন্যে, এ দেশের অর্থনীতির জন্যে; সেটিই আমাদের প্রমাণ করার বিষয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ঘাটতির কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং পুরো সেক্টরের ইমেজ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেখান থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সুশাসন আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমাদের দায়িত্বকে কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান বলেন, নতুন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন পণ্য বা সেবা নিয়ে যখন আমরা এগোব, সেখানে আমাদের আরো ঝুঁকির প্রতি মনোযোগী হতে হবে। আমরা আশা করব আমাদের দুর্বলতাগুলো আমাদের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার মাধ্যমে বের হয়ে আসতে পারব। আমাদের কিছু চাওয়া-পাওয়া সবসময় থাকে। সেখানে আমাদের গভর্নর সবসময় সদয় মনোযোগ দিয়ে থাকেন। আমরা আশা করব ভবিষ্যতে উনার সদয় দৃষ্টি আমাদের প্রতি সবসময় থাকবে।
তিনি আরো বলেন, একটি বা গুটিকয়েক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্যে মাঝেমধ্যে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই কিছুটা শাস্তির মতো কিছু প্রতিবিধানের মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রতি অনুরোধ থাকবে আমাদের ব্যবসায়িক যে সম্প্রসারণ, দেশের মানুষের বা অর্থনীতির প্রতি আমাদের যে অঙ্গীকার সেটিকে যেন আমরা যথাযথ পালন করতে পারি সেজন্য আমাদের যেন একটু সুযোগ দেয়া হয়। এছাড়া একটু সহনশীলভাবে আমাদের নিবেদনগুলো দেখা।
আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক ও এনবিএফআই সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদূরপ্রসারী দিকনির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা দিতে সক্ষম হচ্ছে, যার ফলে দেশের অর্থনীতি ও গ্রাহকরা লাভবান হচ্ছেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, অনুশাসন ও সময়োপযোগী সেবা নিয়ে দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে আইডিএলসি ফাইন্যান্স ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। যোগ্য নেতৃত্ব ও নিবেদিত কর্মীদের নিরলস পরিশ্রম আইডিএলসি ফাইন্যান্সকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বলে আমি মনে করি।
আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী বলেন, এ ধরনের মেলা আমাদের এনবিএফআই সেক্টরকে আরো অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের সেবাগুলোকে তুলে ধরতে সাহায্য করবে। আশা করি এ আয়োজন ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে।
গতকাল সন্ধ্যার বর্ণাঢ্য আয়োজনে মেলার সমাপন ঘোষণা ও ঋণগ্রহীতাদের চেক প্রদান করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এ সময় গভর্নর আনোয়ারা বেগম ও আহসানুল কবিরকে ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণের চেক, ওয়াইল্ড ফ্যাশন বিডির সাবিনা ইয়াসমিনকে আইডিএলসির ৪০ লাখ টাকার ঋণের চেক, বর্ষা নামের এক কিশোরীকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ঋণ হিসেবে আইপিডিসির ৫০ হাজার টাকা ঋণের চেক, ইন স্টাইল বিডিকে লংকা বাংলার ৫ লাখ টাকার ঋণের চেক ও সৌখিন প্রোডাক্টসকে ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ২৫ লাখ টাকার ঋণের চেক প্রদান করেন। চেক প্রদানের সময় সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নির্বাহী ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সন্ধ্যা ৭টায় বণিক বার্তার ব্র্যান্ডিং বিভাগের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় র্যাফল ড্র। এতে বিজয়ীদের মোটরসাইকেল, আইফোন, রেফ্রিজারেটর, ঢাকা-মালদ্বীপ-ঢাকা কাপল বিমান টিকিটসহ ১২টি পুরস্কার দেয়া হয়।