অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক জ্বালানি পণ্যের বাজার। দেশেও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো প্রাথমিক জ্বালানির সংকট প্রকট আকার নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহে টেকসই বিনিয়োগ নিয়ে কার্যকর কোনো সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং এর চেয়ে জ্বালানি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ নিয়েই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে বেশি।
উচ্চমূল্যের কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দীর্ঘমেয়াদি আমদানি চুক্তির আওতায়ও সরবরাহ কমছে পণ্যটির। স্থানীয় পর্যায়ের উত্তোলনও অপর্যাপ্ত। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রিডে চাহিদামাফিক গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিপাকে দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত। দিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে সিএনজি স্টেশনগুলো। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
এমন পরিস্থিতিতেও জ্বালানিটির সরবরাহ নিশ্চিতে নতুন কোনো টেকসই বিনিয়োগ আসছে না। বিশেষ করে এলএনজি আমদানিতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের চেয়ে এখন এলএনজি টার্মিনাল নিয়েই আগ্রহ বেশি বিনিয়োগকারীদের। দেশের গ্যাস সংকটকে মাথায় রেখে ২০১৯ সালে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনালের উদ্যোগ নেয় সরকার। বেসরকারি বিনিয়োগে এ টার্মিনাল নির্মাণ পরিকল্পনায় বিনিয়োগ আগ্রহী হয় অন্তত ১৫টি কোম্পানি। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে আটটি কোম্পানিকে নির্বাচনও করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানিকে এ টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দিতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। কাজ পেতে এ আট কোম্পানির মধ্যে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেনদরবার করে যাচ্ছে তারা।
এর মধ্যেই আবার কক্সবাজারের মহেশখালীতে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চালাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এ টার্মিনাল নির্মাণেও বেশ কয়েকটি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বিচারে জ্বালানি খাতের স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের টার্মিনালটি নির্মাণের কাজ পাওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আমদানিতে উদ্ভূত সংকটের কারণে শিল্প ও আবাসিক খাতে বিদ্যমান অবকাঠামোর সক্ষমতার উপযোগী মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এ সংকট দূর করতে কার্যকর বিনিয়োগের পরিবর্তে অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো এমন এক সময় এসব অবকাঠামো নির্মাণে সবচেয়ে বেশি তত্পরতা দেখা যাচ্ছে, যখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ ঠিক রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাদের ভাষ্যমতে, জ্বালানি খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর চেয়ে অবকাঠামোগত বিনিয়োগে মুনাফা বেশি। বিনিয়োগ ঝুঁকিও কম। এখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে সরকার যথাসময়ে সে প্রকল্প চালু করতে না পারলেও বিনিয়োগ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা নেই। সেক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টিকে অস্বাভাবিক বলা চলে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাথমিক জ্বালানিতে আমাদের গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ হয়নি। অথচ অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রকল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। এসব খাতে বিনিয়োগ করে সুফলও কম। দেশের অনেক জায়গায় গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে অথচ এসব লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি। অথচ এ পরিমাণ অর্থ গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে বিনিয়োগ করা গেলে সেখানে নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেত।
এলএনজির অবকাঠামো নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ রূপ নিচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতায়। এ প্রতিযোগিতাই আবার কখনো কখনো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করছে। মাতারবাড়ীতে স্থলভাগে টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা গেলে এলএনজি সরবরাহের দৈনিক সক্ষমতা বাড়ত আরো ১০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর দেনদরবারে গত তিন বছরে প্রকল্পটির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই এর নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে বলে তারা আশাবাদী।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরুর প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি দ্রুত এ কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
জ্বালানি বিভাগের একটি চিঠি সূত্রে জানা গেছে, এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণে এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনটি পিপিপি সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা জ্বালানি বিভাগের মতামতের অপেক্ষায় রয়েছে।
এলএনজি আমদানি ও নির্মাণ কার্যক্রম-সংক্রান্ত দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পাঁচ দেশের আটটি কোম্পানির সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের দুটি, জাপানের তিনটি এবং ফ্রান্স, ভারত ও কাতারের একটি করে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠানটি হলো টোটাল গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার বিজনেস সার্ভিসেস/ টোটাল গ্যাস ইলেকট্রিসিটি হোল্ডিং ফ্রান্স। মাতারবাড়ী রিগ্যাস টার্মিনাল নির্মাণে জাপান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের সঙ্গে কিয়োসু ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ইনকরপোরেট ও ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের নির্মিত কনসোর্টিয়ামও এ আট প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে। এছাড়া জাপানের আরো দুই প্রতিষ্ঠান মিত্সুই অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড এবং সুমিতমো করপোরেশন ও চুগোকো ইলেকট্রিক পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানি লিমিটেডের কনসোর্টিয়ামও এ তালিকায় রয়েছে। তালিকার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বাংলাদেশের সামিট করপোরেশনের নেতৃত্বে মিত্সুবিশি করপোরেশন (জাপান) ও জেরা কোম্পানি ইনকরপোরেটের কনসোর্টিয়াম, ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের নেতৃত্বে পসকো ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন ও কোরিয়া গ্যাস করপোরেশনকে নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম, ভারতের পেট্রোনেট এলএনজি লিমিটেড ও এক্সনমোবিল এলএনজি মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ইনকরপোরেটকে সঙ্গে নিয়ে কাতার পেট্রোলিয়াম এলএনজি সার্ভিসেস লিমিটেডের নেতৃত্বে গঠিত কনসোর্টিয়াম।
দেশে বর্তমানে বেসরকারি মালিকানাধীন এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে দুটি। এর একটির মালিকানায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেটেড এনার্জি। অন্যটির মালিকানায় রয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ। প্রতিটিরই ৫০ কোটি ঘনফুট করে টার্মিনাল দুটির দৈনিক এলএনজি সরবরাহের মোট সক্ষমতা ১০০ কোটি ঘনফুট।