সম্প্রতি সেনাবাহিনী দ্বারা অং সান সু চি আটক হওয়া এবং মিয়ানমারে এক বছরের জন্য সামরিক আইন জারি করাকে বাংলাদেশ ও বিশ্বের গণমাধ্যমে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এটা কম-বেশি আমাদের সবারই জানা যে মিয়ানমারে আসলে কার্যত একটি বেসামরিক সরকারের মোড়কে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বেই সবকিছু ছিল। তাই আদৌ এ ঘটনাপ্রবাহকে সামরিক অভ্যুত্থান বলা যায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে। যেখানে আইনিভাবে ও বাস্তবে সেনাবাহিনীর মিয়ানমারের শাসনক্ষমতায় যথেষ্ট আধিপত্য ছিল, সেখানে তাদের নতুন করে এ সরাসরি ক্ষমতা দখল কেন ঘটল, তার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। হতে পারে, সামরিক শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতা উপভোগ করছিল, তারা বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কোনোভাবেই ক্ষমতার কোনো আংশিক ভাগাভাগিও সহ্য করতে পারছিল না। আবার হতে পারে, সাম্প্রতিক নির্বাচনে সামরিক বাহিনী সমর্থিত দলের অত্যন্ত খারাপ ফলাফলের ফলে সামরিক বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের ক্ষমতার ওপর কর্তৃত্ব আরো কমে যাবে, এ আশঙ্কা থেকেও অভ্যুত্থানটি করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততা পরোক্ষভাবে হলেও সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখলে আশকারা দিয়েছে, এটা ভাবাও অমূলক নয়।
মিয়ানমারের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে এককালের অবিসংবাদিত গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চি কার্যত সমঝোতা করেই চলছিলেন কিন্তু সাম্প্রতিক এ ঘটনাপ্রবাহ এটা আবারো নির্দেশ করে যে আপসকামিতা ও সুবিধাবাদের রাজনীতি, বিশেষ করে সামরিক শাসনের সঙ্গে এ ধরনের আঁতাতে বেসামরিক শাসকের জন্য সার্বিক বিচারে মঙ্গলময় হয় না। অং সান সু চি একজন ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে বিশ্ব জনমতকে তোয়াক্কা না করে সামরিক বাহিনীকে (আপাতদৃষ্টিতে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে) খুশি করার জন্য এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েও সামরিক বাহিনীর পক্ষে নির্লজ্জভাবে সাফাই গেয়েছেন। তিনি জানেন, বিশ্ব জনমতের মাধ্যমে তিনি মিয়ানমারের ক্ষমতায় যেতে পারবেন না, মিয়ানমারের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এবং জনগণ তার ক্ষমতায় যাওয়ার চাবিকাঠি। তাই তিনি বিভিন্নভাবে সুবিধাবাদের রাজনীতি করেও এটা এখন স্পষ্ট যে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পথে কার্যকর কোনো উত্তরণ ঘটাতে পারেননি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ অবস্থান এবং আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন রকম টালবাহানা থেকে এটি এখন সুস্পষ্ট যে তারা অর্থবহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের এ আশাবাদের কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে বলে কোনোভাবেই মনে হয় না। বেসামরিক বা সামরিক, মিয়ানমারের কোনো সরকারই আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বা ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর থেকে সরাসরি কোনো কার্যকর চাপের মুখে না পড়লে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেবে—এ শুধু আশার ছলনা।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ফলে মিয়ানমারে এখনো আটকে পড়া ৫ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি আরো কোনো নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে আসবে কিনা সেই আশঙ্কাও অনেকেই করছেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থানে রয়েছে। তাই এ পটপরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গারা আরো নির্যাতনের শিকার হবে বা রোহিঙ্গাদের প্রতি কোনো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসবে, এটা ভাবা অযৌক্তিক। আবার সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সীমিত আকারে হলেও মিয়ানমারে যে প্রতিবাদ হচ্ছে বা মিয়ানমারের প্রবাসী নাগরিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন তা থেকেও রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু আছে বলে বলা যায় না। মিয়ানমারের তথাকথিত গণতন্ত্রকামীদের গণতন্ত্রের ধারণা আধুনিককালের গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের বর্বর নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের পরোক্ষ সহযোগিতা বা নির্লিপ্ততা থেকে বোঝা যায়, তাদের গণতন্ত্র হচ্ছে এক ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের কোনো সহমর্মিতা বা তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।
এখানে আরেকটি দিক হচ্ছে সাম্প্রতিক এ পটপরিবর্তনের পরে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ কীভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের মামলা চালাবে বা তারা আদৌ আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে কিনা। অতীতে এ রকম নজির রয়েছে যে একটি দেশ আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করার জন্য হাজির হয়েও প্রাথমিক কোনো আদেশ বা রায়ের পরও পরবর্তী সময়ে আর মামলা শুনানিতে অংশ নেয়নি। যেমন নিকারাগুয়া যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১৯৮০-এর দশকে মামলা করে তখন অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ নিকারাগুয়ার পক্ষে যাওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্র আর শুনানিতে অংশগ্রহণ করেনি। এ মামলা এবং আন্তর্জাতিক আদালতের অন্যান্য মামলা পর্যালোচনা করে আইনিভাবে এটা বলা যায়, আদালতের এখতিয়ার নির্ধারণ হয় যখন মামলা আদালতে দায়ের করা হয়, সেই সময়ের অবস্থার পরিপেক্ষিতে। তাই আইনিভাবে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ এখন যদিও আন্তর্জাতিক আদালতে আর কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করে তবু এ মামলার ফলাফলে বা আইনি বৈধতার প্রশ্নে তার কোনো প্রভাব পড়বে না।
মামলার মেরিট বা সারবস্তুর দিক থেকে বলা যায়, ক্ষমতার এ পটপরিবর্তনের সঙ্গে মামলার সারবস্তুর কোনো যোগসূত্র নেই। আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলাটি করা হয়েছে, সেটি মিয়ানমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নয়। আর রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচার-আচরণের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তাই এ মামলায় সামরিক সরকার সরাসরি ক্ষমতায় আসার ফলে মিয়ানমারের অবস্থানের কোনো গুণগত পরিবর্তন হবে, এমনটা বোধ করি ভাবা অসমীচীন হবে।
আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা চলমান মামলা এবং মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যদি চূড়ান্ত রায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদালত সিদ্ধান্ত দেয় এবং তাতে রোহিঙ্গাদের রক্ষার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়, যদি তখনো সামরিক আইন বহাল থাকে তাহলে সামরিক সরকারের সেই রায়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে। তারা সেই রায় কতটুকু মেনে চলবে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হবে, চীন যখন একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে বিশ্বের ক্রমেই স্পষ্টভাবে আবির্ভূত হচ্ছে তখন তারা মিয়ানমারের পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক একটি বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কীভাবে তাদের যোগাযোগ বজায় রাখে এবং কী প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বিবেচনা করা। চীন রাতারাতি তাদের অবস্থান বদলে ফেলবে এবং মিয়ানমারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে, এটা ভাবা হয়তো বালখিল্যতা হতে পারে। কিন্তু তারা যেভাবে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে ব্যবসা- বাণিজ্য সম্প্রসারণে উৎসাহী ছিল ঠিক একই গতিতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাবে কিনা, তা একটি লক্ষণীয় বিষয়। যদি এখানে বিনিয়োগ বা বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাতে মিয়ানমারের সামগ্রিক অর্থনীতির তথা রাজনীতিতে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি হলে তা সামরিক সরকারের জন্য অন্তত একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা তা বলা যায় না।
মো. রিজওয়ানুল ইসলাম: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক