বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ইহুদি পরিবার

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) যাত্রা ১৯৬৪ সালে। শুরুর দিনগুলোয় চ্যানেলটিতে খবর পাঠ হতো তিন ভাষায়—বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে। সে সময় টেলিভিশনের সাদা-কালো পর্দায় সুদর্শন এক ব্যক্তি তিন ভাষাতেই খবর পাঠ করতেন, যার শুরু হতো এভাবে—‘খবর পাঠ করছি মর্ডিকাই কোহেন’। এ মর্ডিকাই কোহেন বা মর্ডি কোহেনকে বলা চলে বাংলাদেশের ইহুদিদের মধ্যে সর্বশেষ সুপরিচিত ব্যক্তি। ১৯৬৮

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) যাত্রা ১৯৬৪ সালে। শুরুর দিনগুলোয় চ্যানেলটিতে খবর পাঠ হতো তিন ভাষায়—বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে। সে সময় টেলিভিশনের সাদা-কালো পর্দায় সুদর্শন এক ব্যক্তি তিন ভাষাতেই খবর পাঠ করতেন, যার শুরু হতো এভাবে—‘খবর পাঠ করছি মর্ডিকাই কোহেন’। এ মর্ডিকাই কোহেন বা মর্ডি কোহেনকে বলা চলে বাংলাদেশের ইহুদিদের মধ্যে সর্বশেষ সুপরিচিত ব্যক্তি। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যান তিনি। এর আগে অভিনয় করেছেন সাতটি বাংলা সিনেমায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যটি হচ্ছে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (যেটিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন আনোয়ার হোসেন)। ওই সিনেমায় ফরাসি সেনাপতি সাঁফ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মর্ডি কোহেন। 

বাংলাদেশে ইহুদি সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গেলে মর্ডি কোহেনের নামটি বারবার উঠে আসে। ২০১৫ সালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কলকাতায় বাস করতেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিটিভির সূবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে বরাবরই বারেন্দ্র বা বরেন্দ্র অঞ্চলের ইহুদি হিসেবে দাবি করে এসেছেন তিনি। 

তবে মর্ডি কোহেনের পূর্বপুরুষরা পরিচিত ছিলেন বাগদাদি ইহুদি হিসেবে। বাংলায় বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ের উৎস খুঁজতে গেলে সবার আগে উঠে আসে শ্যালোম কোহেনের (১৭৮২-১৮৩৬) নাম। সুরাট থেকে ১৭৯৮ সালে কলকাতায় এসে থিতু হন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গেও ইহুদি সম্প্রদায়ের পত্তনের সঙ্গে তার নাম জড়িত। মসলিন ও রেশমের বস্ত্র নিয়ে ব্যবসা করার জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পাঠিয়েছিলেন তিনি। ১৮১৭ সালে তার বড় মেয়ে লুনাহর সঙ্গে মোজেস ডুয়েক নামে এক ব্যবসায়ীর বিয়ে হয়। ওই দম্পতি ঢাকায় এসে বসবাস করেন পাঁচ বছর। এ সময় তারা এখানে উপাসনার জন্য একটি প্রেয়ার হলও স্থাপন করেন। ১৮২২ সালে পরিবারটি কলকাতায় ফিরে গেলেও এখানকার সঙ্গে সংযোগ পুরোপুরি ছিন্ন করেননি। পরবর্তী সময়ে বাগদাদি ইহুদিরা ঢাকাকে কেন্দ্র করে বস্ত্র, মুক্তা ও আফিমের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। তবে তাদের অধিকাংশেরই বসবাস ছিল কলকাতায়।

প্রকৃতপক্ষে বাংলায় সে সময় ইহুদি সমাজ গড়ে উঠেছিল মূলত কলকাতাকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে ঢাকা ছিল তাদের ব্যবসায়িক কেন্দ্র। গুটিকয়েক ইহুদি পরিবার ওই সময় পূর্ববঙ্গে থিতু হয়ে বসেছিল। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে ইহুদির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে বসবাস করত ১৩৫ জন ইহুদি। তাদের মধ্যে বাগদাদিরা ছাড়াও বেনে ইসরাইল সম্প্রদায়ের ইহুদিরাও ছিল। বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য বলছে, ষাটের দশকেও এ সম্প্রদায়ভুক্ত কয়েকটি পরিবার ঢাকায় বসবাস করত। 

ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন তারিক আলির বরাত দিয়ে বাল্টিমোর পোস্ট এক্সামিনার জানাচ্ছে, স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে দুটি ইহুদি পরিবার ছিল। এর মধ্যে একটি ১৯৭৩ ও আরেকটি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।

তবে ড. শালভা ওয়েইল নামে হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের এক গবেষকের বিভিন্ন রচনায় দেখা যাচ্ছে, এর পরও বাংলাদেশে ইহুদিদের বসবাস ছিল। কানাডার অন্টারিওতে বসবাসকারী জোসেফ এডওয়ার্ড নামে এক বাংলাদেশী ইহুদি তাকে নিজের ও নিজ পরিবারের ইতিহাস লিখে পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।

জোসেফ এডওয়ার্ডের জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রামে। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় চলে যান তিনি। তার পিতা রাহামিম ডেভিড বারুক ও চাচা এজরা বারুকের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। পরে তারা সেখান থেকে তত্কালীন পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। একই সঙ্গে নিজেদের পদবি হিসেবে ‘এডওয়ার্ড’ ব্যবহার করতে শুরু করেন। ডেভিড বারুক হয়ে যান ডেভিড এডওয়ার্ড। এজরা বারুক নাম পাল্টে হন এডি এডওয়ার্ড। জোসেফের পিতা রাহামিম ডেভিড এডওয়ার্ড জাহাজ শিল্পে জড়িত ছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত এক ক্যাথলিক খ্রিস্টানকে। অন্যদিকে তার চাচা এডি এডওয়ার্ড বিয়ে করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক চাকমা রাজকন্যাকে, যিনি সন্তান জন্মের সময় মারা যান। পরে এডি এডওয়ার্ডের সে সন্তানকে এক মুসলিম পরিবার দত্তক নেয়।

মর্ডি কোহেনের মতো জোসেফ এডওয়ার্ডের পরিবারও বাগদাদি ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত। তার এক পূর্বপুরুষ এজরা বারুক বা হাচেম রিউবেন ছিলেন বাগদাদের নামকরা এক র‍্যাবাই পরিবারের সন্তান। ১৯০০ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে জোসেফ এডওয়ার্ডের আত্মীয়স্বজন ইসরায়েলের আরাদ ও বিরশেবা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় বসবাস করছে।

ড. শালভা ওয়েইলের বর্ণনায় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া আরেকটি ইহুদি পরিবারের তথ্য পাওয়া যায়। সত্তরের দশকে ইসরায়েলের লোদ শহরে বসবাস করতেন ‘বেনে ইসরাইল’ সম্প্রদায়ভুক্ত জর্জ রিউবেন। ষাটের দশক পর্যন্ত স্ত্রী দিনা ও তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করতেন তিনি। ওই সময় তিনি পাকিস্তান অক্সিজেন লিমিটেডে চাকরি করতেন। 

২০১৮ সালে ফরেন পলিসি ব্লগসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, ঢাকায় এখনো চারজন ইহুদি বসবাস করছেন, তবে নিজের পরিচয় গোপন করে। কিন্তু এ তথ্য অনেকটাই অসমর্থিত।

মর্ডি কোহেনের মতো বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ইহুদিদের অনেকেই এ দেশকে ভুলে যেতে পারেননি আজীবন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাত্কারে মর্ডি কোহেন রাজশাহীর স্মৃতিচারণা করেছেন বারবার। মা ছিলেন কলকাতার ইহুদি। এ সূত্রে সেখানেই জন্ম তার। অন্যদিকে বাবার পরিবার দেড় শতকেরও বেশি সময় ধরে থিতু ছিল রাজশাহীতে। এ কারণে তার বেড়ে ওঠা রাজশাহীতেই। পড়াশোনাও করেছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। ওই সময় পদ্মার পাড়ে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো রাজশাহী শহরে বাবার দোকান বা স্থানীয় বন্ধুদের স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আজীবন।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পূর্ববঙ্গে ইহুদিবিরোধী মনোভাব বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে সপরিবারে ভারতে চলে যান মর্ডি কোহেন। 

মর্ডি কোহেনের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসেরও কিছুটা যোগসূত্র আছে। তার মামা জেএফআর জ্যাকব বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। মিত্রবাহিনীর ঢাকা দখলের সময় অসামান্য কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে তিনিই রাজি করিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পীঠস্থান জাতীয় সংসদ ভবনের সঙ্গেও এক ইহুদির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ভবনটির স্থপতি লুই আই কান ছিলেন একজন পোলিশ-মার্কিন ইহুদি।

আরও