এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস মহামারীতে পৃথিবীজুড়ে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। এই মহামারীটি পরিবর্তন এনেছে আমাদের জীবনযাত্রায়, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ও কর্মকৌশলে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে এলেও এই মহামারী এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাভাইরাস-উদ্ভূত লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার মুখোমুখি হবে।
বাংলাদেশও এসব আশঙ্কার বাইরে নয়। রাষ্ট্র আজ জীবন ও জীবিকা রক্ষার এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। এই মহামারীর আগে দেশের অর্থনীতি বেশ ঈর্ষণীয় পর্যায়ের ভালো অবস্থায় ছিল। ৭.৫-৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। উচ্চপ্রবৃদ্ধির ফলাফল হিসেবে দারিদ্র্যের হার কমে আসার পাশাপাশি অন্যান্য কল্যাণ অর্থনৈতিক সূচকেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে, ২০১০ সালে যেখানে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ১৭.৬ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা নেমে এসেছিল ১২.৯ শতাংশে (প্রায় ২ কোটি ২১ লাখ মানুষ)। কিন্তু সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে বলা হয়েছে, মহামারী-উদ্ভূত অর্থনৈতিক ধাক্কায় অতিদারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এর অর্থ, লকডাউনের পর দেশের অন্তত অতিরিক্ত ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলো তাই ভীষণ উদ্বেগজনক। তবু বাংলাদেশের জন্য আশার খবর হচ্ছে, দেশের গ্রাম পর্যায়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি খাদ্যনির্ভর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ হলো খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, যা ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারের জন্য চালু করা হয়। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য ও পুষ্টিজনিত সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দুটি লক্ষ্য—এসডিজি ১ (সর্বত্র দারিদ্র্যের অবসান) এবং এসডিজি ২ (ক্ষুধার অবসান) অর্জনে ভূমিকা রাখা। বর্তমানে এ কর্মসূচির আওতায় বড় ভর্তুকির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত গ্রামীণ হতদরিদ্র পরিবারকে প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে মাসে ৩০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়। এই কর্মসূচি পালন করা হয় দেশের দুটি প্রধান ফসল কাটার পূর্ববর্তী শুষ্ক মৌসুমে—বোরো ধান তোলার আগে (মার্চ-এপ্রিল) এবং আমন ধান তোলার আগে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর)। যেহেতু এই সময়ে কাজের সুযোগ কমে আসে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়, তাই ক্ষুধা ও মৌসুমি দুর্ভিক্ষের হাত থেকে হতদরিদ্রদের রক্ষার জন্য এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। সহজেই বোধগম্য হয় যে এটি সরকারের অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি কর্মসূচি, যার জন্য সরকারকে প্রতি বছর ২৬০০ কোটি টাকার বড় ভর্তুকি দিতে হয়।
তবে উদ্দেশ্য ও পরিচালনগত কার্যকারিতার দিক থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকে বেশ সফলই বলতে হবে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) ও ইউনিভার্সিটি অব সিডনির এক যৌথ জরিপে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের প্রায় ৮৫ শতাংশই প্রকৃত হতদরিদ্র অবস্থায় আছে এবং কর্মসূচির বরাদ্দকৃত চালের ১২ শতাংশ তছরুপের ঘটনা রয়েছে; বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের গ্রাম পর্যায়ের রেশনিং কর্মসূচি বা ভারতের পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস) থেকে যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভালো। তাই কভিড-১৯ উদ্ভূত অভিঘাতে নতুন কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো প্রয়োজন—বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুসারে করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রকোপে নতুন করে দরিদ্র হওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য ৫০ লাখ রেশন কার্ড বিতরণের প্রাক্কালে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ওপর ইফপ্রি এবং ইউনিভার্সিটি অব সিডনির যৌথ গবেষণা এবং বর্তমান দারিদ্র্য পরিস্থিতির তথ্য বিশ্লেষণসাপেক্ষে কিছু বিষয় সরকারের বিবেচনায় থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি।
প্রথমত, লকডাউন পরিস্থিতি ও বিঘ্নিত সরবরাহ ব্যবস্থার মধ্যে খাদ্যনির্ভর নিরাপত্তা কর্মসূচি বিস্তৃতকরণ নতুন দরিদ্রদের রক্ষায় এবং এসডিজি-২ অর্জনে সঠিক পদক্ষেপ। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক আঘাতে গ্রাম পর্যায়ে প্রায় ৩২ শতাংশ পরিবার খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। যেহেতু এ মুহূর্তে অভাবের মধ্যে দিনযাপন করা মানুষের কেউ কর্মসূচি থেকে বাদ পড়লে তার ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে অনেক, তাই এই ‘নতুন দরিদ্র’
ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও সুরক্ষা প্রদানে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তবে বাস্তবতার নিরিখে এটিও মনে রাখতে হবে যে প্রধানমন্ত্রীর বর্ধিত কর্মসূচি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা রাষ্ট্রে থাকা খাদ্যের কৌশলগত মজুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। তাই করোনা-পরিস্থিতির স্বাভাবিকতার কোন পর্যায়ে কর্মসূচির এরূপ বর্ধিত অংশ বন্ধ ঘোষণা করা হবে, সরকারের কাছে তার স্বচ্ছ কর্মকৌশল থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দেশের বাইরে ও শহরে কাজ করা অভিবাসীদের অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের তথ্যমতে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সাধারণ ছুটি শুরুর দিন (২৬ মার্চ, ২০২০) প্রায় ১ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক ঢাকা ছেড়েছেন, যা এই শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। অন্যান্য শহর ও নগরাঞ্চলের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। এ জনগণের একটি বড় অংশ অভিবাসী শ্রমিক, যাদের কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ আবার বেতনহীন অবস্থায় আছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, নতুন রেশন কার্ডের সুবিধাভোগীর তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী চিহ্নিতকরণ নীতিমালায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে অভিবাসী সদস্য থাকা পরিবারের দিকে বাড়তি নজর রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, সামাজিক কর্মসূচি কার্যকর করতে অঞ্চল ও সুবিধাভোগীর অবস্থানের দূরবর্তিতা এখনো একটি বড় নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে। ইফপ্রি—ইউনিভার্সিটি অব সিডনির গবেষণায় দেখা যায়, দূরবর্তী দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে বঞ্চিত হওয়ার হার বেশি, অর্থাৎ যাদের সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার কথা, তারা পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে ঢাকা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অঞ্চলগুলোতে যেখানে বঞ্চিতের হার ১৬ শতাংশ, সেখানে ১০০ কিলোমিটার থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলগুলোতে বঞ্চিতের হার ২২ শতাংশ। যখন দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের অধিক, তখন ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বঞ্চিতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া, দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে তছরুপের পরিমাণও বেশি। নতুন কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে, সামাজিক সুরক্ষার পরিচালনগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তছরুপের পরিমাণ হ্রাসের জন্য সরকারের উচিত হবে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দূরবর্তিতার নির্ণায়ক বিবেচনা করা।
সর্বশেষ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ২৯ লাখ শিক্ষার্থী এই মহামারীর লকডাউন পরিস্থিতিতে ‘মিড-ডে মিল’
কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কর্মসূচির অধীনে দরিদ্র উপজেলাগুলোর শিক্ষার্থীরা স্কুলের কার্যদিবসগুলোতে এক বেলা পুষ্টিকর খাবার পেয়ে থাকে। লকডাউন পরিস্থিতি তাই ব্যাপক পুষ্টিহীনতা ও খাদ্য গ্রহণের স্বল্পতা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এই নতুন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত খাদ্য বিতরণের কর্মসূচির বিস্তৃতি বা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাই খেয়াল রাখতে হবে, যেসব পরিবারে প্রাথমিক পর্যায়ের সেসব শিক্ষার্থী রয়েছে, সেসব পরিবার যেন বর্ধিত কর্মসূচির সুবিধাভোগী হতে পারে।
যদিও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এক বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখনো দেশের সব জনগণকে খাদ্য সুরক্ষা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়নে এমন বিবেচনা রাখা উচিত যাতে তছরুপের পরিমাণ হ্রাস পায়, কোনো দরিদ্রকে বঞ্চিত করা না হয় এবং প্রতিটি মূল্যবান জীবন রক্ষা পায়।
লেখক :
শ্যামল চৌধুরী: সহযোগী অধ্যাপক, স্কুল অব ইকোনমিকস, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি
শহীদুর রশিদ: পরিচালক, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)
নাহিয়ান বিন খালেদ: রিসার্চ অ্যানালিস্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ (ইফপ্রি)