নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের ফলে দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যানচালক, মোটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্র্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্র্রমিকসহ অন্যান্য পেশার যেসব মানুষ কাজ হারিয়েছেন তাদের নামের তালিকা ব্যাংক হিসাবসহ দ্রুত তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তালিকা প্রণয়ন সম্পন্ন হলে এককালীন নগদ অর্থ সরাসরি তাদের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হবে। আর এজন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জানি না, এই সংকট কতদিন থাকবে এবং তা আমাদের অর্থনীতিকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবুও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এরই মধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে গোটা বিশ্ব আজ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাস উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব উত্তরণে আমরা চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করেছি। চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাস, আগামী অর্থবছর ও পরবর্তী তিন অর্থবছর—এ তিন পর্যায়ে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। আর কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা, আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমসমূহ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য পাঁচ লাখ টন চাল ও এক লাখ টন গম বরাদ্দ করা হয়েছে, এতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। শহরাঞ্চলে বসবাসরত নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ওএমএসের আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। আগামী তিন মাসে ৭৪ হাজার টন চাল এ কার্যক্রমের আওতায় বিতরণ করা হবে। এজন্য ২৫১ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত ‘বয়স্ক ভাতা’ ও ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’ কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা হবে। বাজেটে এর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৮১৫ কোটি টাকা। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ বাবদ সর্বমোট ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কেউ গৃহহীন থাকবেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্প খাতে যেসব আর্থিক প্যাকেজ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা; অতি-ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা; ইডিএফের সুবিধা বাড়ানোর জন্য ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা; প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফিন্যান্স স্কিমের আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা ও রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ তহবিল বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা।
শেখ হাসিনা বলেন, এই দুঃসময়ে আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু সচল রাখা নয়, আরো জোরদার করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে যাতে কোনো প্রকার খাদ্য সংকট না হয়, সেজন্য আমাদের একখণ্ড জমিও ফেলে রাখা চলবে না। এজন্য কৃষিসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণের ঘাটতি যাতে না হয় এবং সময়মতো কৃষকের হাতে পৌঁছে, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষকেরা যাতে উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য পান, সেজন্য চলতি মৌসুমে গত বছরের চেয়ে ২ লাখ টন অতিরিক্ত ধান কেনা হবে। এজন্য অতিরিক্ত ৮৬০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হচ্ছে। এ তহবিল থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের কৃষি, মত্স্য, ডেইরি ও পোলট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদহারে ঋণ প্রদান করা হবে। কৃষি ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
শেখ হাসিনা বলেন, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে একেবারে সামনের কাতারে থেকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের পেশাটাই এ রকম চ্যালেঞ্জের। এ ক্রান্তিকালে মনোবল হারাবেন না। গোটা দেশবাসী আপনাদের পাশে রয়েছে। আমি দেশবাসীর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। যেসব সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন, এরই মধ্যে তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তাদের বিশেষ সম্মানী দেয়া হবে। এজন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীর জন্য বীমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্যবীমা ও জীবন বীমা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭৫০ কোটি টাকা।
সরকারপ্রধান বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারী থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। যখন যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তা নেয়া হচ্ছে। এ মুহূর্তে আমাদের কোনো খাদ্য সংকট নেই। আল্লাহর রহমতে গত মৌসুমে আমাদের রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে বোরো ধানেরও ভালো ফলন হওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য ও কৃষিপণ্য সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা অটুট রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
দেশবাসীকে ১৪২৭ বঙ্গাব্দের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে-বিদেশে যে যেখানেই আছেন সবাইকে জানাই বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ। বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতিটি বাঙালি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন এ উৎসব। এ বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে পহেলা বৈশাখের বহিরাঙ্গনের সব অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান উদ্ধৃত করে সবাইকে নববর্ষের আনন্দ উপভোগের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা ঘরে বসেই এবারের নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করব। এবার সবাইকে অনুরোধ করব কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজসহ নানা মৌসুমি ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসেই নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন। আপনারা বিনা কারণে ঘরের বাইরে যাবেন না। অযথা কোথাও ভিড় করবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন, পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করুন।
সরকারপ্রধান বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে নিয়োজিত পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী আনা-নেয়ার কাজে এবং মৃত ব্যক্তির দাফন ও সত্কারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীগণসহ জরুরি সেবা কাজে যারা নিয়োজিত রয়েছেন, তাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বক্তব্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙিক্ত উদ্ধৃত করে জনগণকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা ভয় পাবেন না। ভয় মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে। কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না। আমাদের সবাইকে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। সরকার সব সময় আপনার পাশে আছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এ সংকটকালে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। মিডিয়াকর্মীদের প্রতি অনুরোধ, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক তথ্য তুলে ধরে এ মহামারী মোকাবেলা করতে আমাদের সহায়তা করুন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। অতীতে নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঙালি জাতি সাহসের সঙ্গে সেগুলো মোকাবেলা করেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিজয়ী জাতি আমরা। আমরা সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাসজনিত মহামারীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব, ইনশা আল্লাহ। নতুন বছরে মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, মহামারীর এ প্রলয় দ্রুত থেমে যাক। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবাইকে আবারো নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।