দীর্ঘদিন খাদ্যনালির প্রদাহে ভুগলে

ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে

খাদ্যনালি বা ইসোফ্যাজাস হলো একটি দীর্ঘাকৃতির নল, যার মাধ্যমে মুখ থেকে খাদ্য ও পানীয় পাকস্থলীতে পৌঁছায়।

খাদ্যনালি বা ইসোফ্যাজাস হলো একটি দীর্ঘাকৃতির নল, যার মাধ্যমে মুখ থেকে খাদ্য ও পানীয় পাকস্থলীতে পৌঁছায়। নানা কারণে এ খাদ্যনালিতে প্রদাহ হতে পারে, যাকে ইসোফ্যাজাইটিস বলে। দীর্ঘদিন এ রোগে ভুগলে খাদ্যনালিতে গুরুতর ক্ষত, এমনকি ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে খাদ্যনালির প্রদাহ থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করা সম্ভব।

ইসোফ্যাজাইটিসের ধরন

রিফ্লাক্স ইসোফ্যাজাইটিস: আমাদের দেহে খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর সংযোগস্থলে ‘লোয়ার ইসোফেজিয়াল স্ফিংটার’ নামক একটি ভালভ রয়েছে। এ ভালভের কাজ হলো সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্যনালি থেকে খাদ্যদ্রব্যকে পাকস্থলীতে নিয়ে যাওয়া ও পাকস্থলীতে খাদ্য হজমের জন্য যে অ্যাসিড, পেপসিন ও পিত্তরস উৎপন্ন হয়, তা খাদ্যনালিতে আসতে বাধা দেয়া। কিন্তু কোনো কারণে এ স্ফিংটার ভালভের কার্যক্রম ব্যাহত হলে পাকস্থলীতে থাকা অ্যাসিডমিশ্রিত খাদ্য পুনরায় খাদ্যনালি হয়ে আমাদের গলা পর্যন্ত উঠে আসে। তখন গলা জ্বালা বা বুক জ্বালার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। একে অ্যাসিড রিফ্লাক্স বলে। সপ্তাহে যদি দুবার বা তার বেশি অ্যাসিড রিফ্লাক্স হয়, তাহলে এ সমস্যাকে গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা জিইআরডি বলা হয়। জিইআরডির কারণে খাদ্যনালিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি হয়। একে রিফ্লাক্স ইসোফ্যাজাইটিস বলে। ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার খাওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে খাওয়া, অতিরিক্ত চা-কফি পান করা, ধূমপান ও মদ্যপান, রাতে ঘুমানোর আগে ফাস্ট ফুড বা মসলাদার খাবার খাওয়া এবং খাবার খাওয়ার পর পরই ঘুমাতে যাওয়া ও চিত হয়ে ঘুমানো ইসোফ্যাজাইটিসের অন্যতম কারণ।

ইওসিনোফিলিক ইসোফ্যাজাইটিস: অ্যালার্জিজনিত কারণে খাদ্যনালিতে ইওসিনোফিলস নামের এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এটিকে ইওসিনোফিলিক ইসোফ্যাজাইটিস বলে।

সংক্রমণজনিত ইসোফ্যাজাইটিস: কখনো কখনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে খাদ্যনালিতে প্রদাহ হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম এবং ডায়াবেটিস, এইচআইভি এইডস, ক্যান্সার বা অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছেন তাদের সংক্রমণজনিত ইসোফ্যাজাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ওষুধের কারণে সৃষ্ট ইসোফ্যাজাইটিস: কিছু ওষুধ সরাসরি খাদ্যনালির সংস্পর্শে এসে প্রদাহ সৃষ্টি করে। যেমন টেট্রাসাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক, আয়রন ট্যাবলেট, ব্যথানাশক ওষুধ যেমন অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন প্রভৃতি। অল্প পানি বা পানি ছাড়াই ওষুধ গিলে ফেলা কিংবা শুয়ে থাকা অবস্থায় ওষুধ খাওয়ার কারণে এমনটি ঘটতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

ইসোফ্যাজাইটিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

 খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া

 গলায় কিছু আটকে আছে এমন অনুভূত হওয়া

 গলা ও বুক জ্বালাপোড়া করা বা অ্যাসিড রিফ্লাক্স

 মুখে টক বা তিতা স্বাদ ও ঢেকুর

 বুক বা ওপরের পেটে ব্যথা

 বমিভাব বা বমি

 বদহজম

 দীর্ঘস্থায়ী কাশি

 রোগ নির্ণয়

ইসোফ্যাজাইটিস নির্ণয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তার মধ্যে এন্ডোস্কপি অন্যতম। এন্ডোস্কপি পরীক্ষায় ক্যামেরাযুক্ত একটি ছোট ও পাতলা নল খাদ্যনালির ভেতর প্রবেশ করানো হয় এবং খাদ্যনালির ভেতরের অবস্থা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে খাদ্যনালিতে কোনো ক্ষত বা প্রদাহ থাকলে তা সহজেই নির্ণয় করা যায়। কখনো কখনো এন্ডোস্কপি পরীক্ষার সময় খাদ্যনালি থেকে অল্প পরিমাণে কোষ সংগ্রহ করে বায়োপসি করা হয়, যা এ রোগের কারণ, তীব্রতা ও সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া বেরিয়াম এক্স-রের মাধ্যমেও ইসোফ্যাজাইটিস নির্ণয় করা হয়।

ইসোফ্যাজাইটিসের চিকিৎসা

ইসোফ্যাজাইটিসের কারণ ও তীব্রতাভেদে এর চিকিৎসা করা হয়। গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজের কারণে খাদ্যনালিতে প্রদাহ হলে পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিডের পরিমাণ কমিয়ে আনতে অ্যান্টাসিড, ওমিপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, র‍্যাবিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধগুলোর যেকোনো একটি সেবন করা যেতে পারে। ইওসিনোফিলিক বা অ্যালার্জিজনিত ইসোফ্যাজাইটিসের ক্ষেত্রে রোগীকে স্টেরয়েড বা অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। ইসোফ্যাজাইটিস সংক্রমণজনিত কারণে হয়ে থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবে প্রদাহের তীব্রতা গুরুতর আকার ধারণ করলে অনেক সময় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয়

 তৈলাক্ত, মসলাযুক্ত ও অতিরিক্ত টকজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।

 একবারে ভরপেট না খেয়ে অল্প পরিমাণে বারবার খান।

 খাবার খাওয়ার পর পরই ঝুঁকে কোনো কাজ করবেন না এবং খাওয়ার পর কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা পর ঘুমাতে যান।

 চা, কফি, চকোলেট, চিপস ও কোমল পানীয় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।

 ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।

 নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

 ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

 অ্যালার্জি হতে পারে এমন খাদ্য ও বস্তু এড়িয়ে চলুন।

 যেকোনো ওষুধ পর্যাপ্ত পানির সঙ্গে পান করুন।

 চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ সেবন করবেন না।

লেখক: কনসালট্যান্ট, লিভার, পরিপাকতন্ত্র ও মেডিসিন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

চেম্বার: ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিকস), কলাবাগান

আরও