মেরুদণ্ডের টিউমার দ্রুত চিকিৎসায় কমে জটিলতা

মেরুদণ্ড মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যা শরীরের সার্বিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

মেরুদণ্ড মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যা শরীরের সার্বিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে মেরুদণ্ড সুস্থ থাকা জরুরি। তবে অনেক সময় মেরুদণ্ডে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ধরনের রোগ। তেমনই একটি রোগ হলো মেরুদণ্ডের টিউমার। এ রোগের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত হলে এবং দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব

মেরুদণ্ডের টিউমার

মেরুদণ্ডের ভেতরে রয়েছে স্পাইনাল কর্ড বা স্নায়ুরজ্জু। এটি মস্তিষ্ক ও শরীরের অন্যান্য অংশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং বিভিন্ন শারীরিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নানা কারণে স্নায়ুরজ্জুর ভেতরে ও এর আশপাশে অস্বাভাবিকভাবে টিস্যু বা কোষ বেড়ে গিয়ে ছোট ছোট পিণ্ড তৈরি হতে পারে। একে স্পাইনাল টিউমার বা মেরুদণ্ডের টিউমার বলে।

কারণ

সাধারণত মেরুদণ্ডে টিউমার হওয়ার তেমন কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে জিনগত ত্রুটির কারণে মেরুদণ্ডে টিউমার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জিনগত ত্রুটি বংশগত কারণে হতে পারে কিংবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হতে পারে। অনেক সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘদিন বসবাস ও ক্ষতিকারক কোনো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণেও মেরুদণ্ডে টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

টিউমারের ধরন

অবস্থান অনুযায়ী মেরুদণ্ডের টিউমার তিন ধরনের:

১. ইন্ট্রামেডুলারি টিউমার

  • এ ধরনের টিউমার মেরুরজ্জুর ভেতরের কোষে উৎপন্ন হয় এবং ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

২. এক্সট্রামেডুলারি টিউমার

  • এক্সট্রামেডুলারি টিউমার মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডকে আবৃতকারী পর্দা মেনিনজেস ও মেরুদণ্ডের আশপাশের ঝিল্লি বা মেনিনজেসের ভেতরে সৃষ্টি হয়।

৩. মেটাস্টেটিক টিউমার বা ক্যান্সার

  • ফুসফুস, খাদ্যনালি, কিডনি, স্তন, মূত্রথলি, থাইরয়েড গ্রন্থি প্রভৃতি অংশের টিউমার যদি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তাকে মেটাস্টেটিক টিউমার বলে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

মেরুদণ্ডের টিউমারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো পিঠে ব্যথা। এ ব্যথা তীব্র ও স্থায়ী হয় এবং দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • টিউমারটি মেরুদণ্ডের যেখানে রয়েছে সেখানে তীব্র ব্যথা।
  • কিছুক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যথা আরো বেড়ে যাওয়া।
  • হাঁটাচলায় অসুবিধা এবং কোনো কারণ ছাড়াই পড়ে যাওয়া।
  • অনুভূতিহীনতা বা অসাড় বোধ করা।
  • হঠাৎ করে হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া বা পক্ষাঘাত।
  • অন্ত্র ও মূত্রাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া।

রোগ নির্ণয়

মেরুদণ্ডের টিউমার নির্ণয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ পরীক্ষা পদ্ধতিতে উন্নত চৌম্বক ক্ষেত্র ও রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে মেরুদণ্ডের স্পষ্ট ছবি তৈরি করা হয়। ফলে মেরুদণ্ডে টিউমার আছে কি না তা সহজেই নির্ণয় করা যায়। এছাড়া শরীরের অন্যান্য কোষে টিউমার ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তা দেখার জন্য অনেক সময় পিইটি সিটি স্ক্যান করা হয়। মেরুদণ্ডে টিউমার শনাক্ত হলে তার ধরন, বৈশিষ্ট্য ও টিউমারটি কোন পর্যায়ে আছে তা জানার জন্য অনেক সময় বায়োপসি করা প্রয়োজন। বায়োপসির জন্য টিউমার থেকে স্বল্প পরিমাণে কোষ কেটে নিয়ে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়। পরে বায়োপসির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

চিকিৎসা পদ্ধতি

রোগীর বয়স, টিউমারের ধরন ও বিস্তৃতির ওপর ভিত্তি করে তিনটি পদ্ধতিতে মেরুদণ্ডের টিউমারের চিকিৎসা করা হয়।

১. অস্ত্রোপচার: সাধারণ টিউমারের জন্য অস্ত্রোপচারই একমাত্র চিকিৎসা। টিউমারটি যদি প্রাথমিক অবস্থায়ই শনাক্ত হয় বা বেশি ছড়িয়ে না পড়ে, তাহলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে টিউমার ও এর আশপাশের স্থানের কোষ অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয় এবং পরে কেমো বা রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

২. কেমোথেরাপি: টিউমারের আকৃতি বড় হয়ে গেলে এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা পুরোপুরি অপসারণযোগ্য না হলে কেমোথেরাপি দেয়া হয়। এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশেষ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করে টিউমারের কোষ ধ্বংস করা হয়। কেমোথেরাপি অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে যেকোনো সময় দেয়া যায়।

৩. রেডিওথেরাপি: এ পদ্ধতিতে অতি শক্তিশালী এক্স-রে বা বিকিরণ রশ্মির সাহায্যে টিউমারের কোষকে ধ্বংস করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগে রেডিওথেরাপি দেয়া হয়, যাতে টিউমারের আকার ছোট হয়ে আসে এবং অস্ত্রোপচার সহজ হয়। আবার কখনো আক্রান্ত কোষকে পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য অস্ত্রোপচারের পরও রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

সার্জারি বা থেরাপির পর প্রদাহ ও ফোলা কমাতে অনেক সময় কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। এসব ওষুধ ব্যথা কমানোর পাশাপাশি বমি ভাব বা বমি প্রতিরোধেও কার্যকর। তবে ওষুধগুলো অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত মাত্রায় গ্রহণ করা আবশ্যক।

লেখক: নিউরোসার্জন ও স্পাইন সার্জন

ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

আরও