রিউমেটিক ফিভার

রিউমেটিক ফিভারে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া নাবিলার বয়স ১২ বছর। কালেভদ্রে দু-এক চামচ আইসক্রিম খেলেও টনসিলের সমস্যা দেখা দেয়।

ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া নাবিলার বয়স ১২ বছর। কালেভদ্রে দু-এক চামচ আইসক্রিম খেলেও টনসিলের সমস্যা দেখা দেয়। কয়েক সপ্তাহ আগে গলায় সংক্রমণের কারণে ব্যথা হয়েছিল খুব। যেহেতু প্রায়ই টনসিলের ব্যথা হয়, তাই সে সময় খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ইদানীং গলাব্যথা নেই, তবে প্রায়ই জ্বর আসছে। শুধু গা গরম করা জ্বর নয়। জ্বরের সঙ্গে আছে সারা শরীর, হাড় ও অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা। বিশেষত হাঁটু, কনুই, কবজি, পায়ের গোড়ালির ব্যথা যেন সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নাবিলার মা আশঙ্কা করছেন, মেয়ে বোধ হয় বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। অবস্থার অবনতি দেখে নাবিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। লক্ষণগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসক জানালেন, নাবিলা বাতজ্বরে আক্রান্ত। বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার শরীরের অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের এক ধরনের প্রদাহজনিত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর জ্বর ছাড়াও শরীরে তীব্র ব্যথা হতে পারে।

বাতজ্বরের উপসর্গ

বাতজ্বর একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। সাধারণত ৫-১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এটি বেশি হতে দেখা যায়। সবসময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ ধরা নাও পড়তে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর নির্ণয় ও চিকিৎসা হয় উপসর্গনির্ভর।

বাতজ্বর

বাতজ্বরের অন্যতম লক্ষণ হাড় ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা। তবে শুধু হাড় ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হলেই বাতজ্বর, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। উপসর্গ, রোগীর ইতিহাস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাতজ্বর সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়। বাতজ্বরের কিছু মুখ্য ও গৌণ উপসর্গ রয়েছে। রোগীর বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাসজনিত সংক্রমণের ইতিহাস ও এর সঙ্গে দুটি বা তার বেশি মুখ্য উপসর্গ অথবা একটি মুখ্য উপসর্গের সঙ্গে দুটি বা তার বেশি গৌণ উপসর্গ নিশ্চিতভাবে মিলে গেলে বাতজ্বর নির্ণয় করা যায়।

মুখ্য উপসর্গ

 হৃৎপিণ্ডে প্রদাহ

 শরীরের কোনো বড় অস্থিসন্ধিতে ব্যথা বা ফুলে যাওয়া

 হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশে নিয়ন্ত্রণহীন খিঁচুনি

 বুক ও পিঠে লালবর্ণের চাকা

 ত্বকের নিচে ছোট আকৃতির শক্ত ও ব্যথাযুক্ত দানা

 বাতজ্বরের ইতিহাস থাকা হৃৎপিণ্ডের ইলেকট্রিক সিস্টেমের গতি কমে যাওয়া

গৌণ উপসর্গ

 জ্বর

 অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা

 রক্তের ইএসআর অথবা সিআরপি বেড়ে যাওয়া

 রক্তের শ্বেতকণিকা বেড়ে যাওয়া

বাতজ্বর নিয়ে বিভ্রান্তি

বাতজ্বর নির্ণয় ও এর চিকিৎসা নিয়ে অনেকের মধ্যেই রয়েছে নানা রকম ভুল ধারণা। স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে রক্তে এএসও টাইটার বেড়ে যায়। এটি বেড়ে গেলেই অনেকেই মনে করেন বাতজ্বর হয়েছে। তবে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। এএসও টাইটার একটি সহায়ক পরীক্ষা মাত্র। অন্যান্য মুখ্য কিংবা গৌণ লক্ষণ প্রকাশ না পেলে এর বেড়ে যাওয়ায় কিছু এসে যায় না। বাতজ্বর ছাড়াও স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণজনিত স্কারলেট জ্বর, কিডনি রোগ, নিউমোনিয়া, ইরাইসেপালাস ও অন্যান্য কারণে এটি বাড়তে পারে। আবার অনেকেই মনে করেন, বাতজ্বর হলে মেয়েদের সন্তানধারণে অসুবিধা হতে পারে। এটা একেবারেই ঠিক নয়। বাতজ্বর হলে মেয়েদের বিয়ে বা সন্তানধারণে কোনো অসুবিধা নেই। তবে বাতজ্বরজনিত কারণে হৃদযন্ত্রের কপাটিকা বা ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আক্রান্ত মায়ের সন্তানধারণ বিপজ্জনক হতে পারে। সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

চিকিৎসা

বাতজ্বরের কারণে হৃৎপিণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি, হৃৎপিণ্ডের ভালভের জটিলতাসহ নানা ধরনের হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া ভবিষ্যতে হাড়জোড়ার সমস্যাও হতে পারে। তাই পরবর্তী জটিলতা এড়াতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। বাতজ্বরের চিকিৎসা বেশ দীর্ঘমেয়াদি। তবে নিরাময় অযোগ্য নয়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনভাবে একে মোকাবেলা করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যথানাশক ও স্টেরয়েডের প্রয়োজন হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না। বাতজ্বরে আক্রান্ত রোগীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। আক্রান্ত জয়েন্ট নড়াচড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ ভালো না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।

প্রতিকার ও প্রতিরোধ

 স্ট্রেপটোকক্কাস জীবাণু যেন শিশুদের আক্রমণ না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন।

 গলায় সংক্রমণ হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 শিশুদের সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখুন।

 শিশুদের মধ্যে নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

 ঘনবসতিপূর্ণ ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বর্জন করুন।

 স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং প্রচুর পানি পান করুন।

 বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখুন।

আশার কথা হচ্ছে, বাতজ্বরের প্রভাব দিন দিন কমছে। উন্নত দেশগুলোয় এর প্রবণতা একেবারে কম। তবে অনুন্নত দেশ—বিশেষত আফ্রিকান দেশগুলোয় এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। বাতজ্বর একবার ভালো হয়ে গেলে পুনরায় ফিরে আসতে পারে। তাই উপসর্গ ভালো হলেও এর চিকিৎসা বন্ধ করা উচিত নয়। চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।

লেখক: কনসালট্যান্ট মেডিসিন ও কার্ডিওলজি

ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা

আরও