বছরের বর্ষা মৌসুম ও হেমন্তের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের খাল-বিল জুড়ে থাকে শাপলা ফুল। যেমন গ্রামাঞ্চলে তেমনি শহরেও লেক, পুকুরসহ বিভিন্ন জলাশয়ে দৃষ্টিনন্দন এ ফুল মানুষের ভালোবাসার তালিকায় রয়েছে। এটির অনন্য উচ্চতার অন্য কারণ হলো সাদা আর সবুজ রঙের পাঁপড়ির আবরণে বেষ্টিত এই ফুলটি দেশের জাতীয় ফুল।
তবে দৃষ্টিনন্দন এ ফুল ও ফুলের ডাঁটা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সবজি হিসেবে। গ্রামের সাধারণ রান্নাঘর থেকে শহরের দামি ডাইনিং-এও পাতে উঠে আসছে এই শাপলার ডাঁটা। সবজি হিসেবে এই ডাঁটার একটি বড় ধরনের চাহিদাও তৈরি হয়েছে। বিপুল চাহিদার কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সারাদেশের বাজারে শাপলার বেচাকেনা চলে হরদম।
বর্তমানে বিভিন্ন হাটবাজারেও শাপলার দেখা মিলছে, ভালো বেচাকেনাও চলছে।বলা বাহুল্য, এই মুহুর্তে শাপলার ডাঁটাই সবজি হিসেবে বাজারে সবচেয়ে কমদামী পণ্য।
বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জানা গেছে, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র-এ তিন মাস শাপলার মৌসুম থাকায় এ সময় খাল বিল ভরে থাকে শাপলায়। বর্ষাকালে বিল ও ফসলি জমি তলিয়ে থাকার কারণে গ্রামীণ জনপদে প্রচুর পরিমাণে শাপলা জন্মে। এ বছর বর্ষাকাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এখনো খাল-বিলে শাপলা দেখা যাচ্ছে।
গ্রামীণ জনপদের মানুষ ছোট ছোট নৌকা, ডিঙি নৌকা ও সাঁতার কেটে শাপলা সংগ্রহ করেন। সেটা শহরে সবজির দোকান, রাস্তার পাশে ও ভ্যানে বিক্রি হয়। একেকটি আঁটিতে মোট ১০টি থেকে ২০টি করে শাপলা পাওয়া যাচ্ছে। দাম রাখা হচ্ছে ১০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত।
সামায়িক কিছু অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারগুলো এই শাপলা আহরণ ও বিক্রি করে থাকে। কোনোরকম পুঁজির প্রয়োজন হয় না বলে বর্ষা মৌসুমে অনায়াসে শাপলার ব্যবসা করে দরিদ্র পরিবারগুলো একটি ভাল জীবিকা নির্বাহ করছে ও সংসারের চাকা সচল রাখছে।
কুষ্টিয়া শহরে বেশ কয়েকজন শাপলা ডাঁটা বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। কুষ্টিয়া শহরের মিউনিসিপ্যালিটি বাজারে শাপলা ডাঁটা বিক্রয় করতে এসেছেন কুমারখালীর তেবাড়িয়া থেকে নাজমা সুলতানা। চল্লিশোর্ধ এ নারী জানান, তেবাড়িয়া বিলে প্রতি বর্ষাতেই প্রচুর শাপলা জন্মে। জেলেরা মাছ ধরার সময় এ শাপলা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। তাই মাছ ধরার দিন দশেক আগে থেকেই সেখান থেকে তিনিসহ প্রায় ৬ জনের একটি দল এ পর্যন্ত প্রায় ৪ মণ শাপলা সংগ্রহ করে তা বিক্রয় করেছেন কুষ্টিয়া শহরসহ বিভিন্ন হাঁটে ও গ্রামগুলোতে।
নাজমা জানান, শাপলা আঁটিতে বেঁধে বিক্রয় করেন তিনি। তার স্বামী ও দুই ছেলেও এই কাজে তাকে সাহায্য করে। বিনা পুঁজিতে শুধু শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়েছে তাদের।
তিনি জানান, পুরো বিক্রয় থেকে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করেছেন। আগামী আরো এক থেকে দেড় মাস তিনি এই শাপলা বিক্রয় করবেন। তারপর পানি শুকিয়ে যাবে, শাপলাও শেষ হয়ে যাবে।
আরেক শাপলা বিক্রেতা মোহাম্মদ সেলিমকে পাওয়া যায় কুমারখালী উপজেলার এলঙ্গি বাজারে। তিনি একজন ভ্যান চালক। এই মৌসুমে তিনি শাপলা ডাঁটা বিক্রয় করছেন প্রায় ৪ বছর ধরে। তার স্ত্রী নিরালা খাতুন প্রতিদিন তাকে শাপলা তুলে এনে দেন। তিনি সেগুলো ভ্যানে করে বিক্রয় করেন।
তিনি বলেন, এখন তো টাকার দাম কম। এটিও একটি দাম-দড়ের ব্যবসা। ১৫/২০টির একটি আঁটি তিনি ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় করেন। কখনো কখনো তিনি ১০০ আঁটিও বিক্রয় করে ফেলেন।
তিনি বলেন, আগে গরিবেরা এই ডাঁটা নিয়মিত খেত আর বড় লোকেরা অনেকটা শখ করে খেত। কিন্তু এখন প্রতিদিনের সবজি হিসেবে বড় লোকেরাও শাপলার ডাঁটা খাচ্ছেন।
শহরের কলেজ শিক্ষক সাকিলা দোলা জানান, এই ডাঁটা তিনি পছন্দ করেন। মৌসুমের এই সময়ে তিনি এই ডাঁটা সবজি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। বিভিন্ন মাছ ছাড়াও সাধারভাবে ভেজেও এটি রান্না উপযোগী করা যায়।
এদিকে, পুষ্টিবিদরা বলছেন শাপলার ডাঁটার আছে বহুবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. আব্দুর রউফ জানান, এই ডাঁটাতে রয়েছে পানি, ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস এবং প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ভিটামিন ও মিনারেলসের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম আয়রন ইত্যাদি উপাদান।
তিনি আরো বলেন শাপলা ডাঁটাতে রয়েছে একটি বিশেষ উপাদান ফ্লেভনল গ্লাইকোসাইট। এটি মাথার রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে এবং মাথা ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে। শাপলা ডাটার উপাদানগুলো স্নায়ু, পেশী, হার্টের কার্যক্রমে ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাপলা ডাঁটা খেলে ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়। এটি ত্বকের কোষ গুলোকে হাইড্রিয়েটিং এবং স্বাস্থ্যকর করে তোলে।