শহীদ আলতাফ মাহমুদ

মহাকালে যার অনিঃশেষ যাত্রা

১৯৩৩ সালের আজকের দিনে বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার সফিপুর ইউনিয়নের পাতারচর গ্রামে শহীদ আলতাফ মাহমুদের জন্ম।

ফ্যানের সঙ্গে পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিত পাকিস্তানি আর্মিরা। গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ডলে ডলে নেভাত, হাঁটুর হাড় ভেঙে দিয়েছিল। তবুও পিশাচের বক্ষের ওপর বসে, মা, মাটি ও মাতৃভূমিকে ভালোবেসে উন্নত শিরে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ, জাতির বীর সন্তান।

আলতাফ মাহমুদের ডাকনাম ছিল ঝিলু। দিনু বিল্লাহর লেখা, ‘সুরের বরপুত্র শহীদ আলতাফ মাহমুদ‘ বইয়ের একটি অংশে স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছিলেন, একবার সারা বাড়ির দেয়ালে ঝিলু দ্য গ্রেট লিখে রেখেছিলেন ঝিলু। কাঁঠাল গাছে খোদাই করে লেখাটি তার বাবার চোখ এড়ায়নি। বাবা নাজেম মিয়া বলেছিলেন, ‘গাছে খোদাই কইরা আর গানবাজনা কইরা কি আর ঝিলু দ্য গ্রেট হওন যায় রে? পড়াশোনা না করলে তুই কোনোদিনও গ্রেট হইতে পারবি না। সারাদিন খালি টইটই কইরা ঘুইরা বেড়ানো!' তখন মুখে জলের ছিটে দিচ্ছিল ঝিলু। ওখান থেকেই বলেছিল, 'আমি ঝিলু দ্য গ্রেট হইয়াই দেখামু।'

ঝিলু শেষ পর্যন্ত গ্রেট হয়েছিল গণমানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে। ঝিলু দ্য গ্রেট বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাসা মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের নিরাপদ ভাণ্ডার। টর্চার সেলে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধাদের অভয় দিয়ে বলেছিলেন, 'তোমরা সবকিছু অস্বীকার করবে। আমি স্বীকার করেছি, সমস্ত দায় আমার। তোমাদের কোনো দোষ নেই।'

১৯৩৩ সালের আজকের দিনে বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার সফিপুর ইউনিয়নের পাতারচর গ্রামে আলতাফ মাহমুদের জন্ম। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে বিএম কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি চিত্রকলা শিখতে ক্যালকাটা আর্টস স্কুলে গমন করেন। বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই মাহমুদ গান গাইতে শুরু করেন। তিনি প্রথমে প্রসিদ্ধ ভায়োলিনবাদক সুরেন রায়ের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। এছাড়া তিনি গণসঙ্গীত গাইতে শিখেছিলেন যা সেই সময় তাকে অসম্ভব জনপ্রিয়তা ও বিপুল খ্যাতি এনে দেয়।

সংগীতে আলতাফ মাহমুদের হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত বেহালাবাদক সুরেন রায়ের কাছে। এরপর গণসংগীতে যাত্রা শুরু। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম প্রহরে পাকিস্তান স্বাধীন হলে তিনি পাকিস্তানবরণ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। তারও দুই বছর পরে বরিশালের অশ্বিনী কুমার টাউন হলে কৃষকদের এক সমাবেশে তিনি গেয়েছিলেন গণনাট্য সংঘের বিখ্যাত গান 'ম্যায় ভুখা হুঁ'।

আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন ১৯৫০ সালে। সে বছরই যোগ দিয়েছিলেন ধূমকেতু শিল্পী সংঘে। সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদের যাত্রা শুরু হয় 'মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে' গানটি দিয়ে। এই গানটির গীতিকার ছিলেন মোশাররফ উদ্দিন। সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদ অমরত্ব লাভ করেন ১৯৫৩ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিখ্যাত একুশের গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি দিয়ে। অবশ্য এই গানটির তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সুরকার। প্রথমে এই গানটির সুর দিয়েছিলেন সুরকার আব্দুল লতিফ।

শুধুমাত্র গান গাওয়া এবং সুর করার জন্যও আলতাফ মাহমুদকে পাকিস্তানি শাসনামলে শোষকের রোষানলে পড়তে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ে তার গাওয়া দুটি বিখ্যাত গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গানগুলো গাওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিল। গান দুটি ছিল 'মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা', ও 'মোরা কি দুঃখে বাঁচিয়া রবো'। একসময় তিনি গড়লেন পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ। আলতাফ মাহমুদের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে করাচি থেকে। এই রেকর্ডের সুরকার গীতিকার দুটোই ছিলেন তিনি। তার আগে একবার অস্ট্রিয়া যেতে গিয়ে তার পাসপোর্ট বাতিল হয়েছিল, যার ফলে তাকে করাচিতে থাকতে হয়েছিল।

আলতাফ মাহমুদ ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। প্রতিটি গণআন্দোলনে তার ছিল জোরালো ভূমিকা। সেসব আন্দোলনে গানই ছিল হাতিয়ার। গান করেছেন তিনি গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গঞ্জ থেকে বন্দর, নগরে, রাজপথে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিজ বাসায় গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন আলতাফ মাহমুদ। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করে। তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার বাসা থেকে আটক করা হয় আরো অনেক গেরিলা যোদ্ধাকে। এদের অনেকের সঙ্গে তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহীদ আলতাফ মাহমুদের জীবন স্তব্ধ করে দিলেও মহাকালের মঞ্চে আলতাফ মাহমুদের অনিঃশেষ যাত্রাকে ঠেকাতে পারেনি। যুগে যুগে বাংলার গণমানুষের চেতনায় গানের সুর হয়ে মিশে আছেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ।

আরও