ধাতব মুদ্রা প্রচলনের আগের সময়টা ছিল কড়ির সময়। কেবল উড়িষ্যাতেই নয়, বাংলাতেও মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো কড়ি। ৯৪৩ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০০ বছর ধরে বাংলা মালদ্বীপের সঙ্গে বাণিজ্য করতো কেবল কড়ি সংগ্রহের জন্য। মালদ্বীপ ছিল এই অঞ্চলের কড়ি উৎপাদনের বৃহত্তম কেন্দ্র এবং বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এই কড়ি পাওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছে চাল, মশলা এবং রেশম বিনিময় করতো। ব্যবহৃত হত প্রশান্ত মহাসাগরে পাওয়া সাইপ্রিয়া জাতের শামুক যা কড়ি হিসেবেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শক্ত, বহনযোগ্য, অনেকাংশে অভিন্ন এবং নকল করা কঠিন হওয়ার ফলে প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে মুদ্রা হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হতো। ধাতব মুদ্রা প্রচলনের পরও বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হতো সাইপ্রিমোনেটা বা অর্থকড়ি। এমনকি ধাতব মুদ্রার পাশাপাশি একটি সমান্তরাল মুদ্রা ব্যবস্থা গঠন হয়েছিল এই কড়ি দিয়েই।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়টাতে ভারতে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল কড়ির আর্থিক ব্যবহার। ১৮০৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একে বিলুপ্ত ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত ভারতের পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে থাকা বাণিজ্য বন্দরগুলোতে কড়িই ছিল প্রধান মুদ্রা। মুদ্রা হিসেবে কড়িকে বিলুপ্ত করার ফলে বেঁধেছিল বিদ্রোহও। ১৮১৭ সালে কড়ি বিলুপ্ত করার বিরুদ্ধেই গড়ে উঠেছিল উড়িষ্যার পাইকা বিদ্রোহ। মূলত ব্রিটিশদের কড়ি মুদ্রা বিলুপ্তকরণ এবং রৌপ্যে কর প্রদানের জন্য জোর দেয়ার ফলেই এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল।
কেবল উড়িষ্যাতেই নয়, বাংলাতেও মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো কড়ি। তবে বাংলায় ঠিক কবে নাগাদ কড়ি চালু হয় তা স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে পাল-সেন যুগ হয়ে মধ্যযুগের মুসলিম শাসন পেরিয়ে, ব্রিটিশ শাসনামলে প্রায় ১৯ শতক পর্যন্ত বাংলায় মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদেও বিনিময় কাজে কড়ি ব্যবহারের কথা স্পষ্টভাবেই বর্ণিত হয়েছে।
অনলাইনভিত্তিক মুদ্রা ক্যাটালগ নুমিস্তার মতে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ১ রুপির সমান ছিল ২ হাজার ৫৬০টি কড়ি। তবে এই কড়ির মূল্য বা মান একেক অঞ্চলে ছিল একেক রকম। বাংলা থেকে বহুদূরে, ভারতে কয়েকটি কড়ি দিয়েই একটি গরু কেনা যেত, অন্যদিকে কড়ি উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল মালদ্বীপে কয়েক লক্ষ কড়ির দাম ছিল মাত্র একটি সোনার দিনারের সমান।
কড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ইউরোপের বিশাল এক কালো অধ্যায়ের। অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত কড়ি ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের প্রভাবে একটা সময় হয়ে উঠেছিল দাসব্যবসার মূল হাতিয়ার। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়রা যখন ভারতীয় উপকূলে দাস ব্যবসা শুরু করে তখন কড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং ইংরেজদের আফ্রিকার দালালদের কাছ থেকে ক্রীতদাস কেনার জন্য মালদ্বীপের কড়ির প্রয়োজন ছিল। লাভজনক সুযোগ খুঁজে পেয়ে বাংলার ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রির জন্য মালদ্বীপ থেকে কড়ি সংগ্রহ শুরু করে। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস কেনার জন্য প্রায় ২৫ হাজার কড়ি প্রদান করতো।
উনবিংশ শতাব্দীর গড়ার দিকে কলকাতার চিৎপুর রোড আর চব্বিশ পরগণার বাজবাজে ‘দাসবাজার’ ছিল। চিৎপুরের নদীর তীর জুড়ে ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয় করা। পর্তুগিজ ক্রীতদাস জাহাজগুলো কলকাতার ঠিক দক্ষিণের বাজবাজে ভিড়তো। সেখান থেকে ক্রীতদাসদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো সড়কপথে অথবা নদীপথে ছোট নৌকায় করে। তারপর, তারা দিল্লীসহ ভারতের অন্যান্য জায়গায় চলে যেত।
ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো এশিয়া জুড়েই অভিজাত এবং রাজপরিবারগুলোতে কাফ্রি নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস, বিশেষ করে ‘হাবশি’ নামে পরিচিত ইথিওপীয় বা আবিসিনীয় ক্রীতদাসদের প্রচুর চাহিদা ছিল। ১৭৮০ এবং ১৭৯০-এর দশকে কলকাতার পত্রিকাগুলোতেও ক্রীতদাস বাণিজ্য-সম্পর্কিত প্রচুর ইংরেজি বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। এই ক্রীতদাসরা সেনাবাহিনীতে সৈনিকের পাশাপাশি রাজকীয় হারেম এবং অভিজাত নারীদের প্রহরী হিসেবে কাজ করত।
কলকাতা ছাড়াও তৎকালীন বাংলার অন্যান্য বন্দর, যেমন- চট্টগ্রাম এবং উড়িষ্যার বালাসোরও ছিল দাসব্যবসার আঞ্চলিক কেন্দ্র।
বাংলা অঞ্চলে পুরুষ ক্রীতদাসদের দিয়ে জমিতে কৃষক হিসেবে আর গৃহস্থালির কাজ করানো হতো। অন্যদিকে, নারী ক্রীতদাসদের প্রায়ই তাদের মালিকদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাধ্য করা হত। ক্রীতদাসরা মালিকের সামাজিক মর্যাদারও একটি চিহ্ন ছিল। যত বেশি দাস, তত বেশি সম্পদ এবং সমৃদ্ধির চিহ্ন।
বাংলা মুল্লুকে কড়ির বিলুপ্তিও ঘটেছিল দাস ব্যবসা বিলুপ্ত হওয়ার পরই। কারণ দাস ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই কড়ি বিস্তৃতিও লাভ করেছিল ব্যাপক পরিসরে। দাস ব্যবসার সমস্ত বেচাকেনা হতো মূলত কড়ির মাধ্যমেই। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে ব্রিটেন এবং তাদের সবগুলো উপনিবেশে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়। এর ফলে বাংলার দাস ব্যবসা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৮৩০ সাল নাগাদ ধাতব মুদ্রা বাংলায় ভালোভাবে প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থ হিসেবে কড়িকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে।
একটা সময় মানুষের জীবনের দামে মুদ্রায় পরিণত হয়েছিল কড়ি। দাস ব্যবসা বিলুপ্তির পর তাই আবার সাধারণ শামুকই থেকে যায়। তবে ইতিহাসের বিশাল একটি পথ ঘুরে নিজের আলাদা জায়গা নিজেই তৈরি করে নিয়েছে এই সাধারণ শামুক।
তথ্যসূত্র : Cowry and the Slave in British Kolkata - Devasis Chattopaddhay - Academia.edu এবং South Asia Monitor.