পৃথিবীর ইতিহাসে ডাইনোসরের শাসন ছিল এক বিস্ময়কর অধ্যায়। কিন্তু কীভাবে তারা এ শাসন প্রতিষ্ঠা করল, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে গবেষণা করছেন। প্রায় ২৩ কোটি বছর আগে ডাইনোসরের প্রথম উদ্ভবের সময় এরা প্রাণী হিসেবে খুবই সাধারণ ছিল। অন্য অনেক প্রাচীন সরীসৃপের ভিড়ে তাদের আলাদা করে চেনা যেত না। কিন্তু ৩০ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই তারা হয়ে উঠল পৃথিবীর রাজা। মূলত ডাইনোসরের আকার, বৈচিত্র্য এবং শক্তি তাদের দুনিয়ার শাসক করে তুলেছিল। যেখানে তাদের পূর্ববর্তী সরীসৃপদের বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেখানে ডাইনোসর হয়ে ওঠে আরো বেশি শক্তিশালী।
ডাইনোসরের এ রহস্যের সমাধানে সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিওন্টোলজিস্ট মার্টিন কোয়ার্নস্ট্রম এবং তার দল এক দশক ধরে গবেষণা চালিয়েছেন। তারা নজর দিয়েছেন ডাইনোসরের মল এবং বমির জীবাশ্মের দিকে, যা ব্রোমালাইটস নামে পরিচিত। তাদের বিশ্বাস, এই জীবাশ্মগুলোতে লুকিয়ে আছে ডাইনোসরের বিবর্তনের গোপন রহস্য।
গবেষণা দলের সদস্যরা পোল্যান্ডের দক্ষিণে পোলিশ বেসিন থেকে প্রায় ৫০০টিরও বেশি ব্রোমালাইটস সংগ্রহ করেন। এই জীবাশ্মগুলো প্রায় ২৪৭ মিলিয়ন থেকে ২০০ মিলিয়ন বছর আগেকার, অর্থাৎ লেট ট্রায়াসিক থেকে আর্লি জুরাসিক যুগের।
২০ কোটি বছর আগের জীবাশ্ম মল
তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জীবাশ্মগুলোর আকার ও বৈচিত্র্য বেড়েছে। এটি মূলত বৃহত্তর প্রাণীদের উপস্থিতি এবং তাদের নতুন খাদ্যাভ্যাসের দিকে ইঙ্গিত দেয়। ব্রোমালাইটসের ভেতর কী রয়েছে, তা জানতে বিজ্ঞানীরা থ্রি ডি স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন।
কিছু জীবাশ্ম মল দেখতে একেবারে আধুনিক প্রাণীর মলের মতো। তবে অনেক সময় তৃণভোজী প্রাণীর মল চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। স্ক্যানের মাধ্যমে মলের ভেতরে মাছ, পোকামাকড়, উদ্ভিদ এবং শিকার প্রাণীর অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। এমনকি কিছু জীবাশ্মে অর্ধেক মাছ বা ক্ষুদ্র পোকামাকড় এতটাই নিখুঁত অবস্থায় ছিল যে মনে হচ্ছিল এগুলো সদ্য ফেলা হয়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই জীবাশ্মগুলো ডাইনোসরের খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের বিবর্তনের ধাপ বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এই গবেষণার একটি বড় অংশ ছিল ডাইনোসরের খাদ্যাভ্যাস ও তাদের বিবর্তনের ধাপগুলো বোঝা। বিজ্ঞানীরা পাঁচটি পর্যায়ে ডাইনোসরের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চিহ্নিত করেছেন। প্রথম পর্যায়ে তাদের পূর্বপুরুষেরা ছিল সর্বভুক, অর্থাৎ তারা উদ্ভিদ এবং প্রাণী উভয়ই খেত। পরে তারা মাংসাশী এবং তৃণভোজী—এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়।
পরবর্তী সময়ে আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা বাড়লে উদ্ভিদের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়, যা বড় ও বৈচিত্র্যময় তৃণভোজী ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটায়। এই পর্যায়েই প্রথম বৃহৎ মাংসাশী ডাইনোসরদের উদ্ভব ঘটে। এরপর প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয় জুরাসিক যুগ, যেখানে ডাইনোসরের শাসন আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞানীদের দাবি, ডাইনোসরের প্রতিযোগী সরীসৃপরা তাদের খাদ্যাভ্যাসের সীমাবদ্ধতার কারণে বিলুপ্ত হয়। তবে ডাইনোসরের খাদ্যাভ্যাস ছিল তুলনামূলক বৈচিত্র্যময়। ধারণা করা হচ্ছে, খাদ্যাভ্যাসের এই ভিন্নতাই ডাইনোসরদের পৃথিবীর বুকে এতদিন টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল।
প্রথম তৃণভোজী বৃহদাকার ডাইনোসরদের বলা হতো সরোপডোমর্ফস। এদের মলে পাওয়া গেছে গাছের ফার্ন, বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং কাঠকয়লা। এ থেকে ধারণা করা যায়, প্রাচীন ডাইনোসরের খাদ্যাভ্যাস শুধু মাত্র এক দিকে আবদ্ধ ছিল না। বরং এটি ছিল বৈচিত্র্যতায় ভরপুর।
গবেষণা প্রধান লেখক গ্রেজগোজ নিডজউইডজকি বলেন, ডাইনোসরের বিবর্তনের সাফল্যের রহস্য ছিল তাদের খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য। তিনি বলেন, এই গবেষণা আমাদের বর্তমানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়: সবজি খান আর দীর্ঘজীবী হোন!
ডাইনোসরের উত্থানের পেছনের জটিল কারণগুলো গবেষকদের মধ্যে নতুন করে আবার চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পৃথিবীর অন্য অঞ্চলে এই ধরনের গবেষণা চালিয়ে তাদের বিবর্তনের আরো বিস্তারিত ছবি তৈরি করা সম্ভব।