মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে তা নিয়ে সবাই কমবেশি আতঙ্কিত। কিন্তু সব আলোচনাই যেন একটি জায়গায় এসে আটকে পড়ছে আর তা হলো অর্থনীতির সংকট ও ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বাড়ানোর কারণেই ব্যাংকগুলোর পতন হয়েছে। অথবা আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে অর্থ তুলতে থাকায় ব্যাংকগুলো ধসে পড়েছে। বিষয়টি কি শুধুই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ? আমানতকারীরা কি কোনো কারণ ছাড়াই অর্থ তুলতে ব্যাংকে লাইন দিয়েছে নাকি এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে?
একের পর এক ব্যাংকের পতনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের দুর্বলতাগুলোই নতুন করে সামনে চলে আসছে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর দেশটির সরকার আমানতকারীদের সুরক্ষার জন্য ডড-ফ্রাঙ্ক আইন পাস করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল বড় ব্যাংকগুলোর পতন বা বন্ধ হলে যেন অর্থনীতির সংকট তৈরি না হয় এবং লাখ লাখ মানুষকে পথে বসতে না হয়। কিন্তু সে সময় ওয়াল স্ট্রিটের প্রধান নির্বাহীসহ তাদের আইনজীবী এবং লবিস্টরা এ আইনকে প্রতিহত করতে একজোট হয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। এমনকি আইনটি যেন পাস না হয় সেজন্য লাখ লাখ ডলার খরচ করতেও তারা দ্বিধা করেননি। আইনটি পাস হওয়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে প্রধান নির্বাহীরা সেটিকে দুর্বল এবং এর প্রয়োগ স্থগিত করতেও লাখ লাখ ডলার ব্যয় করেছিলেন।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (এসভিবি) প্রধান নির্বাহী গ্রেগ বেকার ছিলেন অনেক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নির্বাহীদের মধ্যে একজন, যিনি ডড-ফ্রাঙ্ক আইনটিকে দুর্বল এবং এর প্রয়োগ থামাতে জোর লবিং করেছিলেন। তাদের লবিংয়ের কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ডড-ফ্রাঙ্ক আইনের কিছু ধারায় সংশোধনও এনেছিলেন। সে সময় ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন জেরোম পাওয়েল। তিনিও তাতে সায় দিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক বন্ধ করে দেয়ার আগে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংকে পরিণত হয়েছিল। অথচ ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীরা দাবি করেছিলেন, তারা এত বৃহৎ ব্যাংক নয় যে তাদের কঠোর তদারকি করতে হবে। এমনকি আইন মানতে ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান গাইডলাইন অনুসরণেও তাদের উদাসীনতা ছিল লক্ষণীয়।
দুঃখজনক বিষয় হলো ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন এসভিবির দখল নিতে ছুটে আসার কয়েক ঘণ্টা আগেও এসভিবির কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ‘অভিনন্দনমূলক বোনাস’ বণ্টনে ব্যস্ত ছিলেন। অথচ ব্যাংকটি অসংখ্য গ্রাহকদের অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিল, এমনকি কর্মচারীদের বেতনও পরিশোধ করতে পারছিল না। ব্যাংকটি পতনের কয়েক দিন আগে এসভিবির মালিক ও এসভিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের কর্মকর্তারা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি এসভিবির প্রধান নির্বাহীও সপ্তাহখানেক আগে তার অধীনে থাকা শেয়ার বিক্রি করেছেন।
যেটি অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন সেটি হলো এসভিবির স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়ম ভঙ্গ ও দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। সবাই এসভিবি পতনের জন্য ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। এটি একটি কারণ বটে, তবে একমাত্র কারণ নয়। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে ব্যাংকটি সংকটে পতিত হয়েছে। অতিমাত্রায় ঝুঁকি নেয়ার কারণেই তারা সংকটে পড়েছে। এ কথাও সত্য, ফেডারেল রিজার্ভ এসভিবির পতনের দায় এড়াতে পারে না। কারণ ব্যাংকটি তদারকিতে তারা উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংকটির ঝুঁকি সঠিকভাবে নিরূপণ করেনি।
একদিকে এসভিবির ছিল অভ্যন্তরীণ সমস্যা, অন্যদিকে বৈশ্বিক ও দেশের দোদুল্যমান অর্থনীতি ব্যাংকটির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাবক হিসেবে। দুর্বল তদারকি ও অধিক ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতার কারণে এসভিবি আজ ভুগছে। পুরো ব্যাংকটির আমানত ও ঋণ দেশের একটি খাতকে কেন্দ্র করে আবির্ভূত হয়েছে। বড় আমানতের বিপরীতে পর্যাপ্ত বীমাও করেনি তারা। শঙ্কা ছিল প্রযুক্তি খাতটি কোনো কারণে দুর্বল হলে ব্যাংকটিও দুর্বল হয়ে পড়বে। বাস্তবে হয়েছেও তাই, এসভিবির আজকের ভারসাম্যহীনতার পেছনে এক খাতনির্ভরতা বড় ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংক সাধারণত ঝুঁকি এড়াতে এক খাতে অধিক বিনিয়োগ করে না। তাদের ঋণের পোর্টফোলিও হয় বৈচিত্র্যময়। কিন্তু এসভিবি এসব কোনো নীতিই মেনে চলেনি। করোনা মহামারীর সময়ে প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলোর কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ব্যাংকটি। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন ও পরিচালনা ব্যয়ের টাকা রাখতে এসভিবি ব্যাংককেই বেছে নিত। কারণ এ ব্যাংক থেকে তারা সহজেই ঋণও পেত। গত বছর থেকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের অনেকেই এসভিবি থেকে আমানত তুলে নিতে শুরু করে। কিন্তু ব্যাংকটির কাছে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধে পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। কারণ এসভিবি এসব আমানত দীর্ঘমেয়াদের বন্ডে বিনিয়োগ করেছিল। ফলে নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে ব্যাংকটি লোকসানেই বন্ড বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে ৮ মার্চ এসভিবি পুঁজিবাজার থেকে পৌনে ২ বিলিয়ন ডলার মূলধন সংগ্রহের ঘোষণা দেয়। এতে গ্রাহকরা মনে করেন, ব্যাংকটি বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ ধারণা থেকেই ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে আমানত উত্তোলন করা শুরু করে। এর দুদিন পরই ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়।
সম্পদ ও দায়ের সময়সীমার অসামঞ্জস্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার এক অন্যতম সমস্যা। স্বল্পমেয়াদি আমানতের টাকা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলে যেকোনো কোম্পানি তারল্য সংকটে পড়বেই। এসভি ব্যাংক এই ‘মিসম্যাচ’ ক্রমাগত চালিয়ে গেছে। আমানত সঞ্চয়কারীদের জন্য সম্পদ হলেও ব্যাংকের জন্য তা দায়। এ ধরনের ১৭৫ বিলিয়ন ডলার দায়ের বিপরীতে এসভি ব্যাংক প্রায় সমপরিমাণ মার্কিন সরকারি সিকিউরিটিজ বা বন্ড কিনেছিল, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ। তবে সেগুলোর অধিকাংশই কেনা হয়েছিল কভিডের সময়ে, যখন বন্ডের ওপর সুদ ছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কভিডকালে প্রযুক্তি ফার্মগুলো তাদের বর্ধিত আয় দুই হাতে জমাতে থাকে এসভি ব্যাংকে।
সে সময় শেয়ারবাজার অনিশ্চিত থাকায় এসভি ব্যাংক প্রায় সব আমানত সরকারি বন্ডে ঢেলে দেয়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে যে পরিবর্তন আনতে হবে—সে কথা খুব একটা ভাবেননি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) গ্রেগ বেকার। ভাবলেও বন্ডগুলোর বাজারদর ভালো ছিল না বিধায় ওগুলোর ম্যাচিউরিটি ডেট পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। সেটিই ব্যাংকটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফেডারেল রিজার্ভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির রিস্ক ম্যানেজমেন্টের প্রধান কর্মকর্তা লরা ইজুরিতা ২০২১ সালের অক্টোবরে চাকরির মেয়াদ শেষ করলেও একই পদে ছিলেন ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। এদিকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নতুন একজন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রধান নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও ইজুরিতার পদ আঁকড়ে থাকার কারণে বড় কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেননি তিনি। নিয়ম না মেনে অধিক ঝুঁকি গ্রহণ করায় ব্যাংকটি স্বল্পমেয়াদে উচ্চমুনাফা অর্জন করেছিল। গত তিন বছর এসভিবির গড় মুনাফা অর্জনের হার ছিল ৪০ শতাংশের ওপর। কিন্তু স্বল্পমেয়াদে উচ্চমুনাফার জন্য তাকে কী মূল্য দিতে হচ্ছে এখন তা আমরা সবাই জানি, ব্যাংকটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে হয়েছে।
এসভিবির পতনের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের পুরো ব্যাংক খাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। সিগনেচার ব্যাংকের পতন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অধিক ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা। ব্যাংকটি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল। ব্যাংকগুলোর সংকট কাটাতে সরকার ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যবস্থা নিয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে এবারের বেইলআউট প্যাকেজটি ২০০৮ সাল থেকে আলাদা। কিন্তু সেটি শুধু কাগজে-কলমে, বাস্তবে একই। ব্যাংকগুলোকে জনগণের অর্থে বেইলআউট করার আগে তাদের সক্ষমতা যাচাই করে দেখা দরকার। তাদের বিজনেস মডেলে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তা দূর করা এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও প্রয়োজন।
ব্যাংকের এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে এসভিবি ও সিগনেচার ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি তুলছেন দেশটির বিশেষজ্ঞরা। এসভিবি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বেকার গত বছরও ৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার বাড়ি নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার তিনি নিয়েছেন মুনাফা বৃদ্ধি ও অধিক ঝুঁকি গ্রহণের পুরস্কার হিসেবে। একইভাবে সিগনেচার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী জোসেফ ডিপাওলো গত বছর নিয়েছেন ৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। এটিও তিনি পেয়েছেন ঝুঁকি গ্রহণের পুরস্কার হিসেবে। অথচ এ ঝুঁকি গ্রহণের কারণে ব্যাংক দুটি আজ সংকটে। দেশটির আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব নির্বাহীর বেতন-বোনাসসহ সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয় নিয়মিত খতিয়ে দেখা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত করে দেখা উচিত তারা কোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল কিনা। তারা দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন ভঙ্গ করেছে কিনা সেটিও তদন্ত হওয়া উচিত। প্রধান নির্বাহীদের সুযোগ-সুবিধার আওতা সীমাবদ্ধ করে দেয়ার দাবিও তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত ২২ বছরে ৫৬৩টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। আবার নতুন করে কার্যক্রমে এসেছে অনেকে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে, এতে কি আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন না। অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগে আমানতকারীরা অর্থ হারাতেন, এখন তাদের আমানতের কিছু অংশ বীমা করা থাকায় ক্ষতির শঙ্কা কিছুটা কম। বীমার পরিমাণ আড়াই লাখ ডলার। যারা এর বেশি আমানত ব্যাংকে রেখেছেন তাদের শঙ্কা বেশি। তাদের রক্ষা করতে সরকার এগিয়ে এসেছে। অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করার কথা চলছে। এরই মধ্যে কিছু শেয়ার লেনদেনও হয়েছে। তবে কমবেশি সব আমানতকারীই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এতে। অর্থ পেতে দেরি হওয়া থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ অর্থ না পাওয়ার ঘটনাও ঘটবে। তবে তাদের একটা ভরসা হলো দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ না হলেও একটি-দুটি ব্যাংক যে সংকটে পড়েনি তা নয়। নব্বইয়ের দশকে একটি ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি বন্ধ করে দেয় এবং একাধিকবার হাত বদল হওয়ার পরও তার গ্রাহকরা সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে অর্থ পায়নি।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও এসভিবি ও সিগনেচার ব্যাংকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছে। একটি কোম্পানি বা একটি খাতে অধিক বিনিয়োগের সমস্যা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও বিদ্যমান। প্রতিটি ব্যাংকেরই বড় তিন থেকে পাঁচটি ঋণগ্রহীতা ব্যর্থ হলে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না। তাছাড়া ব্যাংকের ঋণ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতেও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সেটি স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যাংক বাঁচাতে সরকার অর্থ প্রদান করেছে। কিন্তু যেসব অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলো দুরবস্থায় পতিত হচ্ছে তা বন্ধে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যাংক বাঁচাতে বা আমানতকারীদের রক্ষায় বিলিয়ন ডলার বেইলআউট করতে পারলেও বাংলাদেশ পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। মাঝে ইসলামী ধারায় পরিচালিত ব্যাংক থেকে আমানত ওঠানোর হিড়িক পড়লে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যায় ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। কিন্তু যেসব কারণে ব্যাংকগুলো সংকটে পড়েছিল তা রোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এমনকি দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম অমান্য করে ব্যবসা পরিচালনার জন্য কাউকে জবাবদিহিও করতে হয়নি।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের জন্য প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ব্যাংক সাধারণ জনগণের আমানত ও সঞ্চয়ের জিম্মাদার। সাধারণত ব্যাংক একটি সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামোর আওতায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে জটিল এ পরিস্থিতিতে উচ্চমাত্রার মূলধন বা ‘ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও’ বজায় রাখা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের দিক দিয়ে দেখতে গেলে উচ্চমাত্রার মূলধন ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য নির্দেশ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন ক্যাপিটাল বা মূলধন যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, কোনো কোনো ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতিও রয়েছে। বিশ্বের উন্নত অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ক্যাপিটাল বা মূলধনের দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে।
‘সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ হচ্ছে সবচেয়ে সময়োপযোগী ও কার্যকরী পন্থা, যা ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে পারে। এ ব্যাপারে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। ‘সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’-এর অংশ হিসেবে একটি চৌকস দল নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ, পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্বকে অবগতকরণ এবং এসবের ভিত্তিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণমূলক কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকা আবশ্যক। ব্যাংক খাতে স্থিতিশীল অবস্থা আনার জন্য এ ধরনের কার্যক্রম চলমান রাখা জরুরি। সম্ভাব্য ঝুঁকি ও আর্থিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও অংশীদারি পক্ষগুলোর কাছে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি। ব্যাংক খাতে ঝুঁকিগুলো চিহ্নিতকরণ ও প্রকৃত মূলধনের পরিমাণ নিরূপণ এবং যথেষ্ট পরিমাণ সংরক্ষণ করে আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুত হওয়ার বিকল্প নেই।
এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা