বিশ্লেষণ

লুণ্ঠক বনাম উৎপাদক: আমরা এবং আমাদের চাষী ভাইয়েরা

অন্যদিকে যারা উৎপাদক তারা সম্পদ বা মূল্য সৃষ্টি করেন। তার পুরোটা সর্বদা ভোগ করেন না। কিছুটা যত্ন করে সঞ্চয় করেন। সেটা পুনরায় বিনিয়োগ করেন ও বর্ধিত সম্পদ উৎপাদন করেন। সুতরাং তারা উৎপাদক, স্রষ্টা ও বিনিয়োগকারীও বটে। তাই তাদের ভাণ্ডারটি বাড়তে থাকে। তারা প্রবৃদ্ধির ও কর্ম নিয়োজনের চালিকাশক্তি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেই প্রবৃদ্ধি অন্যের সৃষ্ট উদ্বৃত্তমূল্য শোষণ বা লুণ্ঠন করে দেশে

আমাদের সমাজে লুণ্ঠক রয়েছে। কাদেরকে আমরা ‘লুণ্ঠক’ বলব? তারা হয় অন্যেরটা লুট করেন অথবা অন্যেরটা ধার নিয়ে পরে আর ফেরত দেন না। ক্ষমতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। অর্থাৎ তারাই লুণ্ঠক যারা ক্ষমতাবান ও অন্যেরটা লুট করে নিতে সক্ষম। লুণ্ঠিত সম্পদ বা অর্থ তারা প্রায়ই অপব্যবহার করেন অথবা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। তারা ইতিবাচক উৎপাদক তো নয়ই, তারা লুণ্ঠকও শুধু নয়, তারা পাচারকারী।

অন্যদিকে যারা উৎপাদক তারা সম্পদ বা মূল্য সৃষ্টি করেন। তার পুরোটা সর্বদা ভোগ করেন না। কিছুটা যত্ন করে সঞ্চয় করেন। সেটা পুনরায় বিনিয়োগ করেন ও বর্ধিত সম্পদ উৎপাদন করেন। সুতরাং তারা উৎপাদক, স্রষ্টা ও বিনিয়োগকারীও বটে। তাই তাদের ভাণ্ডারটি বাড়তে থাকে। তারা প্রবৃদ্ধির ও কর্ম নিয়োজনের চালিকাশক্তি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেই প্রবৃদ্ধি অন্যের সৃষ্ট উদ্বৃত্তমূল্য শোষণ বা লুণ্ঠন করে দেশে তা পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধির মধ্যে আপেক্ষিক বৈষম্য লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু পুঁজি বাইরে পাচার হলে দেশ একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধিবঞ্চিত হয়, বৈষম্যও বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে লুণ্ঠক চিহ্নিতকরণ

বাংলাদেশে যারা খেলাপি ঋণগ্রহীতা তারা সবাই কি লুণ্ঠক? তারা সবাই হয়তো লুণ্ঠক নয়। একটি ক্ষুদে উৎপাদক বা অল্প সম্পদের মালিক (ধরা যাক বর্গাচাষী বা ক্ষুদে মালিক) যখন ঋণ গ্রহণ করেন তখন তা প্রথমত তার ভোগ বা বিনিয়োগের প্রয়োজনেই করে থাকেন। হয় সেটা দিয়ে তিনি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয় করেন, না হয় তা উৎপাদনশীলভাবে কাজে লাগিয়ে সম্পদ সৃষ্টি করেন। ঋণের শর্ত অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে তা তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফেরত দেন অথবা ফেরত দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও করেন। কখনো না পারলে তিনি ভাগ্যকে দোষ দেন এবং বাধ্য হয়ে নিজের মূল্যবান জামানতটি বিক্রি করে ঋণ শোধ করেন। কখনো মহাজন বা ব্যাংকই তার ওই সম্পদ অনাদায়ী ঋণের জন্য বাজেয়াপ্ত করে নেয়। সেটা ঠেকানোর জন্য তার কোনো পেশিশক্তি নেই, নেই কোনো উচ্চ ক্ষমতাবান মহলের সঙ্গে যোগাযোগ, তাছাড়া উপরন্তু রয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভীতি। তাই তিনি ঋণের টাকা যথাসময়ে ফেরত দিতে না পারলে শাস্তিটুকু মাথা পেতে নেন বা নিতে বাধ্য হন। এদের তাই লুণ্ঠক বলা যায় না। ‘লুণ্ঠকের’ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা সাধারণত অনেক বড় সম্পদ, অর্থ ও ক্ষমতার মালিক। তাদের সর্বদাই বৃহৎ ঋণের প্রয়োজন হয়। তারা ১ লাখ বা ১ কোটি টাকা নয়, শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে থাকেন। আর প্রায়ই তারা এ অর্থ যথাসময়ে শোধ করেন না। ফলে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঋণ শোধ না করলে তাদের কেউ আইনের আওতায় আনতে পারেন না কেন? তাদের তো ঋণ শোধ করার সক্ষমতা না থাকার কারণ নেই। অন্তত সুদ এবং কিস্তি দেয়ার ক্ষমতা তো তাদের থাকার কথা। তাদের অন্যান্য বহুমুখী বিনিয়োগ সম্পদভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় কিস্তি তুলে নিয়ে তারা তা দিতে পারেন। তারা সেটুকু দিচ্ছেন না, তার কারণ হচ্ছে তারা বৃহৎ, তারা ক্ষমতাবান এবং তারা নিজেরাই ব্যাংক মালিক। তাই বর্তমানে ব্যাংকের ঋণদাতাদের তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। ফলে খেলাপি ঋণের ব্যাপারটা তাদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা ব্যতিক্রম নয়, বেপরোয়া মনোভাব বা সুবিধাবাদের পরিণতি মাত্র। তারা যদি ঋণ শোধ না করলে অসুবিধায় পড়তেন (ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার মতো ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হতেন, বিপুল সামাজিক লজ্জা পেতেন বা বাড়ির ইলেকট্রিসিটি সংযোগ বা পানি সংযোগ বন্ধ হয়ে যেত বা গাড়ি-বাড়ি বাজেয়াপ্ত হয়ে যেত তাহলে কী হতো?) তাহলে হয়তো ব্যাপারটা এ রকম হতো না। তারা জানেন, খেলাপি হলে শাস্তি ছাড়াই তারা ঘুরে-বেড়াতে পারবেন, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন এবং আরো খেলাপি হওয়ার জন্য সামান্য অর্থ (২ শতাংশ) শোধ দিয়ে বৃহত্তর নতুন ঋণের পুনঃতফসিলীকরণ করতে পারবেন। আরো বড় ঋণ নিয়ে আরো বড় খেলাপি হতে পারবেন। এদের আশা একসময় এ ঋণ মওকুফ হয়ে যাবে। তাই তারা ঋণের প্রয়োজন না হলেও ঋণ নিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়—আছে যার ভূরি ভূরি’। অতি মুনাফালোভী পুঁজির বিশ্বব্যাপী এ অস্বাভাবিক ব্যাধি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাংকগুলোকে এ কারণে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই বেইলআউট করতে হয়েছিল।

তবে যারা জাতির/সমাজের কথা ভাবেন এবং সেই অর্থে ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ বা ‘সামাজিক উদ্যোক্তা তারা বৃহদায়তন ঋণ উৎপাদনশীলভাবে বিনিয়োগ করে বৃহদায়তন উৎপাদন সম্পূর্ণ করেন বা তা করতে গিয়ে কখনোবা ভুল করে ক্ষতির স্বীকার হলেও তাদের মধ্যে পালিয়ে না গিয়ে, নিজের দেশে থেকে ঋণের দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা থাকে। তারা সচরাচর পালিয়ে যান না, বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করেন না। প্রকৃত বিচক্ষণ উৎপাদনশীল বৃহৎ উদ্যোক্তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার ডিমগুলো কখনই এক বাক্সে রাখেন না। ফলে ভূমিকম্প হলে কোথাও এক জায়গায় ডিম নষ্ট হলেও, অন্যত্র ডিম ফুটে বাচ্চা ঠিকই তৈরি হয়। তাই তার কোথাও ক্ষতি হলেও অন্য জায়গা থেকে লাভ দিয়ে তা পুষিয়ে দিতে পারেন। ফলে সামগ্রিকভাবে তারা ঋণের কিস্তি প্রদানে সহজে ব্যর্থ হন না। কিন্তু আমাদের লুটেরা ঋণখেলাপিরা সে রকম নয়। যে লোভী উদ্যোক্তা, যে ক্ষমতাবান উদ্যোক্তা, যে অর্বাচীন উদ্যোক্তা, অর্থ ও সম্পদ ধার নিয়ে তা অনুৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করে বা তা বাইরে কোথাও পাচার করে লুকিয়ে রাখে এবং কর ফাঁকি দিয়ে, ঘুস দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে, মামলা করে ঋণ শোধের বাধ্যবাধকতা থেকে বেঁচে যেতে চায় ও পারে তাদেরকে রাষ্ট্র কর্তৃক বল প্রয়োগ ছাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

এদেরকেই আমরা ‘লুণ্ঠক’ বলছি এবং তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় তাদের কাছে পাওনার পরিমাণ এত বৃহৎ হয়ে যায় যে তাকে স্পর্শ করলে বা তাকে জেলে ভরলেও টাকাটা আর ঋণদাতা মাঠ থেকে তুলে আনতে পারেন না। এমনকি তার মোট জামানতের মূল্যও তখন ঋণের চেয়ে কম হয়ে যায়। সম্প্রতি বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘৯ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বন্ধকি সম্পত্তির বুদ্বুদের ওপর ব্যাংক, জমিসহ বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে খেলাপি ঋণ আদায় অতি নগণ্য’ (দেখুন, হাছান আদনানের প্রতিবেদন, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বর্তমানে এ ধরনের লুণ্ঠকদের কবলে পড়েছে। না তাদের গিলতে পারছে—না তাদের উগড়ে দিতে পারছে।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত?

২০০৯ সালে বর্তমান দীর্ঘস্থায়ী সরকারের যাত্রা শুরুর সময় খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। ছয় বছর পর ২০১৫ সালে তা পরিণত হয়েছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায়। এরপর মাঝখানে কভিডকালে আমরা উদারভাবে ঋণ বিতরণের ও ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সিদ্ধান্ত নিই। তাতে এখন এ মুহূর্তে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের কভিডের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবানুসারে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আমরা এ হিসাব করেছি অনেক রেখে-ঢেকে। কিন্তু আইএমএফের স্ট্যান্ডার্ড হিসাবানুসারে প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের (Stressed Loan) প্রকৃত পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের সঙ্গে পুনঃতফসিলীকৃত ঋণও যোগ করে হিসাব করা হয়েছে। এরপর এটির সঙ্গে যেসব ঋণ আদায়যোগ্য নয় বলে বাতিল করে (Written off) দেয়া হয়েছিল সে রকম ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকাও যদি যোগ করা হয় তাহলে মোট খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। তাই প্রকৃত হিসাবে ব্যাংক খাতে মোট প্রদত্ত ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশই বর্তমানে হচ্ছে খেলাপি/দুর্দশাগ্রস্ত/বাতিল ঋণগুলোর সমষ্টি। 

খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রগুলো কোথায় বেশি?

হাছান আদনানের করা দৈনিক বণিক বার্তার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখের একটি প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের মোট খেলাপি ঋণের ৫৫ শতাংশ সৃষ্টি হয়েছে শিল্প খাতের ঋণে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্প ও নির্মাণ খাত। এদের খেলাপির পরিমাণ, এদের মধ্যে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ। পোশাক খাতে প্রদত্ত ঋণের মধ্যে খেলাপির হার কম ১১ শতাংশ। বস্ত্র ও চামড়া শিল্পেও এ হার ১১-১২ শতাংশ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যতিক্রম হচ্ছে কৃষি খাত! 

কৃষি খাতে খেলাপি ঋণের হার মাত্র ৩ শতাংশ। কৃষি খাতে ঋণ পরিশোধে এ বিশেষ সাফল্যের কারণ সহজেই অনুমেয়। কারণ তারা এ দেশে এখনো ক্ষমতাবান শ্রেণীতে পরিণত হতে পারেননি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, যে যত বড় ঋণ নিচ্ছে তিনি তত বড় খেলাপি হচ্ছে। পক্ষান্তরে, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা কি কৃষি খাতে কি মাইক্রো-ক্রেডিটের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ ঋণ ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন। দুর্বলরা ঋণখেলাপি হচ্ছেন না বা হতে পারছে না। সবলরা ঋণখেলাপি হচ্ছেন এবং হতে পারছেন।

হাছান আদনানের প্রতিবেদনে প্রদত্ত বছরওয়ারি তথ্য থেকে আরো জানা যায় যে ২০১৮-১৯ সালে কৃষি খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সে বছর তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা হয়েছিল ২৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে প্রদত্ত ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা, আদায় হয়েছিল ২৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩-এ প্রদত্ত ঋণ ছিল ৩২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা, আদায় হয়েছিল ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। এসব হিসাব থেকে বোঝা যায় যে কৃষি খাতে প্রতি বছর যে সামান্য ঋণ ব্যাংক খাত থেকে দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে সর্বদাই বেশি টাকা সেখান থেকে ব্যাংক খাত উঠিয়ে নিচ্ছেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘চাষী গৃহস্থের’ কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়ে ‘চোর শিল্পপতিদের’ ব্যাংক খাত টাকা ঋণ দিচ্ছে।

হাছান আদনানের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে ব্যাংক খাতের প্রদত্ত সব ধরনের ঋণের মাত্র ৩-৪ শতাংশ ঋণ কৃষি খাতে গেছে। সুতরাং ঋণ পরিশোধে দক্ষ কৃষকরা ঋণের সুবিধা পাচ্ছেন আপেক্ষিকভাবে মাত্র ৩-৪ শতাংশ। অথচ সেটি দিয়েই তারা আমাদের অন্ন জুগিয়ে চলছেন। আবাদি জমি কমে যাচ্ছে, কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাচ্ছে, ফসলের লাভজনক দাম খুচরা পর্যায়ে ভোক্তারা দিলেও মধ্যস্বত্বভোগী বা আমদানি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কৃষক সেই লাভটা সামান্যই পাচ্ছেন। এমনকি কখনো কখনো ঠিকমতো স্টোর সুবিধা ও ই-মার্কেটিং সুবিধা না থাকায় ফসল তোলার মৌসুমে কৃষকরা অল্প দামেই তাদের ফসল ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। উপরন্তু এখন কর্মীর ভাড়াও অনেক বেড়ে গেছে। ফলে উদ্যোক্তা ধনী কৃষক, মধ্য কৃষক এবং চুক্তিভিত্তিক ভাড়াটে প্রান্তিক বা ভূমিহীন চাষীরা জমি-উপকরণ-শ্রম বাবদ সব কিছু দিয়ে-থুয়ে নিট আয়ের ক্ষেত্রে হাতে রাখতে পারছেন খুবই কম। তার পরও ঋণ পরিশোধে তাদের কোনো কার্পণ্য দেখা যাচ্ছে না।

প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণগ্রহীতারা এখন সরাসরি কৃষি ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন কম—নিচ্ছেনও কম। এনজিও এবং বিভিন্ন ঋণদাতা এজেন্সিগুলো বর্তমানে ব্যাংক থেকে কম সুদে টাকা ধার নিয়ে তাতে আরো সার্ভিস চার্জ যোগ করে এখন উচ্চতর সুদের হারে উৎপাদক কৃষককে ঋণ দিচ্ছেন। ফলে উৎপাদক চাষীর ঘাড়ে সুদের হারের বোঝা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২০-২২ শতাংশ। তাই আজ আমরা একটি অদ্ভুত বিষয় দেখছি—বেশি হারে সুদ দিয়ে, বেশি প্রতিকূলতার মধ্যে উৎপাদন করে, বেশি হারে ঋণ শোধ করছেন যারা তারা হচ্ছেন আমার দেশের কৃষক সমাজ। আর কম সুদের হারে ঋণ নিয়ে কম ঋণ শোধ করছেন যারা তারা হচ্ছেন দেশের শিল্পপতি সমাজ।

তাই এ প্রবন্ধ শেষ করব মেহনতি কৃষকদেরই খাঁটি উৎপাদক হিসেবে চিহ্নিত করে। আর তাদেরই জানাব অন্তরের অন্তস্তল থেকে আন্তরিক অভিনন্দন। দাবি করব রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে—কৃষকদেরই আরো ঋণ, আরো উন্নত প্রযুক্তি, আরো ভর্তুকি, আরো জ্ঞান, আরো আধুনিক বাজার গঠনের সুবিধা প্রদান করা হোক। তাহলে এ দেশে প্রবৃদ্ধিও হবে, উন্নয়নও হবে, বৈষম্যও কমবে, ঋণখেলাপিও কমবে।

ড. এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও