দেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে ও রিজার্ভ বাড়ানোর অন্যতম খাত প্রবাসী আয়। নানামুখী সংকটে থাকা অর্থনীতিতে স্বস্তি এনে দিতে পারে এ আয়। আবার রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নমুখী হলে তা সংকটগুলোকে প্রকট করে তোলে। দুঃখজনকভাবে আগে থেকে বিদ্যমান তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমেছে। মূলত দুই মাস ধরে নেতিবাচক ধারায় রয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে প্রবাসী আয় কমেছে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স সংক্রান্ত তথ্যে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে দেশে ১৯১ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। এর পরের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এসেছে যথাক্রমে ২২২ কোটি ৪২ লাখ ও ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। অক্টোবরে কিছুটা কমে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। আর সদ্যসমাপ্ত নভেম্বরে এসেছে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স।
সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির ধারা নিম্নমুখী হলেও গত বছরের অক্টোবর থেকে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কিন্তু জুলাইয়ে এসে সে ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। কেননা জুলাইয়ে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে বিগত সরকার ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি, দেখামাত্র গুলির মতো নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চালানো হয় যার উত্তেজনা প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকার কয়েক দেশে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেন। এসব সমাবেশ থেকে রেমিট্যান্স ‘শাটডাউনের’ ঘোষণা দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত জুলাইয়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয়। জুলাইয়ে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। তবে গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু আবারো কেন প্রবাসী আয় কমতে শুরু করেছে সেটি উদ্বেগের বিষয়। এর পেছনে বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন অর্থনীতিবিদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন যে আমরা ধরেই নিয়েছি রেমিট্যান্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে, কিন্তু তা নয়। রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। যাতে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ বোধ করেন। সুতরাং সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে ও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে সরকারের যত দ্রুত সম্ভব দৃশ্যমান কিছু উদ্যোগ নেয়া দরকার। নীতিগত জায়গায় প্রয়োজনে পরিবর্তন আনতে হবে।
দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় হুন্ডি। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় অংকই হাতছাড়া হয়ে যায়, যার বার্ষিক মোট পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। আবার প্রবাসে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো গত ১০ বছরে ভিসার জন্য হুন্ডির মাধ্যমে ১৩ দশমিক ৪ লাখ কোটি টাকা লেনদেন করেছে বলে বাংলাদেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটির তিন মাসের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ তথ্যগুলো বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় প্রাপ্তির বড় প্রতিবন্ধকতাকে নির্দেশ করে। সুতরাং হুন্ডি বাজার কীভাবে পুরোপুরি বন্ধ করা যায় সেদিকে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে। প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ দিতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জটিলতা কমাতে হবে। এর জন্য প্রবাসীদের সঙ্গে শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। তাদের সেবার মানও উন্নত করতে হবে। প্রবাসীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার প্রতিও নজর দিতে হবে। এছাড়া বিমানবন্দরে নানা হয়রানি বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। স্বল্প আয়ের প্রবাসীদের সরকারিভাবে প্রণোদনা বাড়ানোও আবশ্যক। ভারত, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনের প্রবাসীরাও নানা ধরনের সুবিধা পান।
এর বাইরে রেমিট্যান্স বাড়াতে দেখতে হবে বৈদেশিক শ্রমবাজারে কী ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। যেমন বাংলাদেশীদের জন্য সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি থেকেই সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসত। কিন্তু গত দুই বছর বেশি প্রবাসী আয় আসছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে দ্বিতীয় স্থানে যুক্তরাষ্ট্র। আর সৌদি আরব থেকে আসছে তৃতীয় সর্বোচ্চ। একসময় সর্ববৃহৎ প্রবাসী আয়ের উৎসের দেশ কেন তৃতীয় সারিতে চলে গেল বা অন্য শ্রমবাজারের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিশেষ কাজে দক্ষতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রদান করবে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। ব্যাপক জনশক্তি বিদেশে যাওয়ার পরও প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স না পাওয়ার অন্যতম কারণ উচ্চ মানের কাজ না পাওয়া। প্রবাসীরা প্রশিক্ষিত না হওয়ায় তুলনামূলক বেতন-ভাতা কম পান। তাই বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
আর অনতিবিলম্বে এ পদক্ষেপগুলো নেয়া প্রয়োজন। কারণ ডলার সংকট ও রিজার্ভ নিয়ে এখনো চাপের মুখে দেশের অর্থনীতি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বকেয়া পরিশোধ, ঋণের কিস্তি ও সুদ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির ব্যয় মেটাতে সরকারকে মূল্যবান ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় সেটি সরকারের বৈদেশিক ব্যয় মেটানোর চাপ কমাতে কিছুটা সহায়ক হয়েছে। তাই বলা যায়, বর্তমানের রেমিট্যান্স প্রবাহ নেতিবাচক ধারা থেকে ইতিবাচক ধারায় না ফিরলে অর্থনীতির সেসব চাপ আরো ঘনীভূত হবে।