রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটি বলেছেন ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী থাকলেও উৎসবের দিনে সে হয়ে ওঠে বৃহৎ এবং মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভবে মহৎ।’ হয়তো বৃহৎ ও মহৎ হওয়ার ইচ্ছায় বাংলাদেশের মানুষের উৎসবে শামিল হওয়ার আগ্রহে কমতি দেখা যায় না বরং বাড়ে। বাংলা বর্ষপঞ্জির নতুন মাসের প্রথম তারিখ পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণে বাঙালির অন্তহীন আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের মধ্যে জেগে ওঠে প্রাণবন্ত অর্থনীতিরও অবয়ব। বর্ষবরণকে ঘিরে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই জমজমাট প্রস্তুতির বড় অংশ ঘিরেই থাকে অর্থনীতি। যেমন করোনা বিধ্বস্ত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল সয়েও এবারের পহেলা বৈশাখ ঘিরে ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের, হাতবদলের প্রত্যাশা সবার। রমজান মাস চলছে, নয়দিন পর আসছে মেগা উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদের প্রাক্কালে পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটি সজ্ঞান সংকুচিত আবহ বিরাজ করতেই পারে, তা সত্ত্বেও রাজধানীসহ সারা দেশের নগরীর বিপণিবিতান, মার্কেট শপিং মল থেকে শুরু করে ফুটপাত ছেয়ে গেছে বৈশাখ ও ঈদের সামগ্রী ও রকমারি পোশাকে। বৈশাখ ও ঈদ উপলক্ষে দেয়া হচ্ছে আকর্ষণীয় সব অফার। পরিবহন খাতে বরাবরের ন্যায় মহাব্যস্ততা বাড়ছে, বাড়বেই। পদ্মা সেতুর এবারই প্রথম ঈদ উদযাপন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। পরিবহন খাতে (যা বাংলাদেশের উৎসবের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য হিস্যা পেয়ে থাকে) এবার একটা গুণ ও পরিমাণগত পরিবর্তন সূচিত করছে সন্দেহ নেই।
পহেলা বৈশাখে বসে নেই মাছ ও খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরাও। অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে সরবরাহের মরাকাটালে ইলিশের দাম আকাশচুম্বী। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে মধ্যবিত্তের কাছে ইলিশ এখন মহার্ঘ হলেও বড়লোকদের কাছে এখনো ইলিশ ফ্যাশন ও ঐতিহ্য হিসেবে দেদীপ্যমান। শহরে প্রচলিত পান্তা-ইলিশের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনে নববর্ষ উদযাপনের কোনো মিল আছে বলে মনে হয় না। নববর্ষে গ্রামের মানুষ শখ করে পান্তা খায় না। ইলিশ মাছ অনেকে চোখেও দেখে না। এটি কেবলই শহুরে জীবনে নতুন সংযোজন। যার ফলে চৈত্রসংক্রান্তির আগে থেকেই দাম বেড়ে যায় ইলিশের। বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকারে মরিয়া হয়ে ওঠে প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত জেলেরা। খাদ্য তালিকায় পান্তা-ইলিশের অকারণ অন্তর্ভুক্তি ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে জেলেদের সিন্ডিকেট মনোভাবের জন্য দায়ী।
এ উৎসব ঘিরে অন্য সময়ের চেয়ে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ওঠানোর পরিমাণও বেড়েছে। চার বছর থেকেই বৈশাখী অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে নববর্ষের বোনাস। প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উৎসব ভাতা পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা। এ বোনাসের কয়েকশ কোটি টাকা এবার এসেছে বৈশাখের বাজারে। আবার এ সপ্তাহেই মিলবে ঈদের বোনাস। অর্থাৎ এই এপ্রিলেই বৈশাখী বোনাস, ঈদ বোনাস এবং মাসের বেতন একসঙ্গে বাজারে আসবে, সরকারি-বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের এ মোটা পকেট বাজারে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াবে, সঙ্গে সঙ্গে দ্রব্যমূল্যও, যে পরিস্থিতিটি দরিদ্র নিম্নবিত্তদের জন্য হবে শাঁখের করাতের মতো।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ ‘বাংলা নববর্ষ’ উদযাপনের স্বতঃস্ফূর্ততা নগর পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। এ উৎসব ঘিরে পাখা মেলছে নানামুখী বাণিজ্যও। বাংলা নববর্ষ বরণ করতে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে পার্ক-উদ্যান, পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের। শহরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে বৈশাখী তাঁতবস্ত্র মেলা। পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করে এরই মধ্যে কেনাকাটা, হালখাতার প্রস্তুতি, পাইকারি দোকানগুলোয় চলছে শেষ মুহূর্তের বেচাকেনা। পহেলা বৈশাখ এখন দেশের বাইরেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। অর্থনীতির জন্য এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। এতে দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্ত ও কারুশিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বৈশাখী মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি উপযুক্ত পরিচর্যায় আন্তর্জাতিক বাজারেও এসব কারুশিল্প উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে এখন বছরে প্রায় ৮০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের হস্তশিল্পসামগ্রী বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
বৈশাখী অর্থনীতির বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ মেলা ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্য যত বেশি বিক্রি হবে, ততই গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। নানা আয়োজনে সাজানো পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ পোশাক। কেরানীগঞ্জ, ইসলামপুর, নবাবপুরসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি মার্কেটে এক মাস আগে থেকেই বৈশাখের পোশাক কেনাকাটা শুরু হয়েছে। দুঃখজনক যে সম্প্রতি বঙ্গবাজারের অপমৃত্যু এবারের উৎসবের অর্থনীতিতে ধাক্কা দিয়েছে, দেবে। সারা দেশের অর্ধেক বৈশাখী পোশাক তৈরি হয় কেরানীগঞ্জে। রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেট, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, গুলশান, মিরপুর-উত্তরাসহ বিভিন্ন মার্কেটে ও শপিং মলগুলোয় দেদার বিক্রি হচ্ছে বৈশাখের পোশাক। মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বৈশাখের কেনাকাটায় তরুণ-তরুণী ও নারী ক্রেতাদের সংখ্যাই বেশি। মিরপুর বেনারসি পল্লীর ব্যবসায়ীদের কয়েক দিন ধরেই বেচাকেনা জমে উঠেছে। এখন গড়ে প্রতিদিন তাদের একশর বেশি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পহেলা বৈশাখের উৎসব সফল করতে মৃৎশিল্পের বিশেষ কারুকাজ, সরা আঁকা, মিছরির মিষ্টি বানানো, খৈ তৈরি, কাপড় বোনা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ উৎসবমুখর পরিবেশে চলছে।
বৈশাখ ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ফুল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চাঙ্গা হয়। প্রতিদিন রাজধানীতে পাইকারি বাজারে ৩০-৩৫ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। সে হিসেবে বৈশাখ ঘিরে ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছেন ফুল ব্যবসায়ী সমিতি।
বাংলা নববর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হালখাতা। একসময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক কালে হালখাতার প্রভাব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের পরিধি প্রসারিত হওয়ার ফলে বাকির খাতায় স্থিতি অনেকটা কমে গেছে। তাতে আকর্ষণ হারাচ্ছে হালখাতার অনুষ্ঠান। বৈশাখে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে প্রয়োজনীয় খাবার মজুদ থাকে। আনন্দ-উৎসবের জন্য প্রস্তুত থাকে সবাই। সব বয়সের মানুষ মুখিয়ে থাকে বৈশাখী মেলার জন্য। এ সময় বটতলা ও গ্রামীণ হাটকে সাজানো হয় নানা রঙে। মেলায় আসে তাঁতে বোনা পোশাক, মাটির হাঁড়িপাতিল, মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রী। শিশুদের খেলনা, কাঠের ও বেতের দ্রব্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র।
রাজস্ব আহরণই ছিল বাংলা সন প্রবর্তনের প্রেরণা
বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। এর গোড়াপত্তন হয় ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে হিজরি ক্যালেন্ডার ধরে পরিচালিত হতো রাজকর্ম। চান্দ্র সন অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো কৃষকদের কাছ থেকে। কিন্তু সৌরবর্ষের তুলনায় চান্দ্রবর্ষ ১০-১১ দিন কম থাকায় খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষকদের জটিলতার মধ্যে পড়তে হতো। তাছাড়া কৃষক বিভিন্ন ফসলের চাষ করতেন ঋতু অনুযায়ী। ফসল তোলার পরই খাজনা নেয়ার ছিল প্রকৃষ্ট সময়। সম্রাট আকবর তাই প্রবর্তন করেন ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খান পহেলা বৈশাখ থেকে খাজনা আদায় শুরু করেন। বাংলা নববর্ষের দিনে খাজনা আদায়ের এ আয়োজনের নাম ছিল ‘রাজপুণ্যাহ’। ‘পুণ্যাহ’ চালুর অনেক বছর পর ব্রিটিশ শাসনামলে পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান চালু হয়। হালখাতা পহেলা বৈশাখের একটি স্থানীয় অনুষ্ঠান। নতুন বছরের হিসাব-নিকাশের জন্য নতুন খাতা আরম্ভের উৎসব এটি। তৎকালীন গ্রামের কৃষকরা বাকিতে তাদের দৈনন্দিন কেনাকাটা করতেন। ফসল ঘরে উঠলে ফসল দিয়েই অথবা ফসল বিক্রির অর্থ দিয়ে বাকি পরিশোধ করত।
অতএব, বাংলা সন প্রচলনের শুরুটাই হয়েছিল অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। সে সময় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন গ্রামের কৃষক ও জমির খাজনা। এর বিপরীতে সম্রাট শাহজাহানের মতো প্রেমিকের তাজমহল নির্মাণের ব্যয়ের বহর বিনা অডিটে বিনা কণ্ঠভোটে হয়ে যেত পাস। এখনো আমজনতার ত্যাগ ও কষ্টে অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্যকে এবং প্রকৃতির শর্তহীন সহযোগিতাকে পুঁজি করে দায়মুক্ত ব্যয় বাহুল্যে বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থনীতি। উৎসবে তাই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বণ্টনবৈষম্যের বিবরে এমন এক সমাজ, যে সমাজকে শোষণ ও বঞ্চনামুক্তির জন্য লাখ লাখ মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছিল।
কেনাকাটা ও আনন্দ আয়োজনে বৈশাখী মেলা
দীর্ঘকাল থেকেই বৈশাখ নিয়ে নানা আয়োজন হয়ে আসছে বাংলাদেশে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে আসছে বৈশাখী উৎসবে। একটা সময় পর্যন্ত এটা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক উৎসব। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা প্রভাবও রাখত। ষাটের দশক থেকে বৈশাখ নগরকেন্দ্রিক হতে শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশাখ শহরের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। বড়দের পাশাপাশি শহরের আধুনিক ছেলেমেয়েরাও দেশী শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ এবং পাঞ্জাবি-লুঙ্গি, ফতুয়া পরে আনন্দে মেতে ওঠে এদিন। শুধু তা-ই নয়, অনেক বিদেশীকে ঢাকার রাস্তায় শাড়ি-লুঙ্গি পরে হাঁটতে দেখা যায়। কোথাও তারা নেচে-গেয়ে নানা হই-হুলোড় করে।
পোশাকের পাশাপাশি পান্তা-ইলিশ, জিলাপি, হরেক রকমের ফুলের মালা, বাঁশিসহ দেশী বিভিন্ন লোকবাদ্যযন্ত্রেরও বিক্রি বেড়ে যায় বৈশাখ উপলক্ষে। এমনকি পহেলা বৈশাখে রিকশাচালকদেরও বাড়তি আয় হয়। অনেকেই রিকশায় ঘুরতে পছন্দ করেন এদিন। রিকশাওয়ালাকে বাড়তি পারিশ্রমিকটা হাসিমুখেই দেন তারা।
এভাবে নানাদিক থেকে আমাদের অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখ ভালোই প্রভাব রেখে আসছে। কোন ফ্যাশন হাউজ কত নতুন ও আকর্ষণীয় বৈশাখী পোশাক শো-রুমে তুলতে পারে—এটা নিয়ে প্রতি বছরই প্রতিযোগিতা চলে। পুরান ঢাকার ওয়ারী, বসুন্ধরা শপিং মল, ধানমন্ডি এলাকার পোশাকের বিপণিগুলোয় বৈশাখী পোশাকের পসরা সাজায়। রাপা প্লাজার ‘জয়িতা’ ফ্লোরটিতে অনেকগুলো বুটিকস হাউজ আছে—এদের পণ্যগুলো নারীদের তৈরি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমেই পরিচালিত।
বৈশাখে একটু বাড়তি আয়ের আশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
মাটির তৈরি তৈজস—টিয়া, গরু, ছাগল, হরিণ, মোরগ, ময়না, দোয়েল, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লিচু নিয়ে মেলায় দোকান বসান মৃৎশিল্পের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সারা বছর এগুলো অল্প পরিসরে বিক্রি হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বৈশাখী মেলায়। শিশুরা মাটির তৈরি এসব জিনিস কিনতে খুবই আগ্রহী, শো-কেসে সাজানোর জন্য শখের বশে বড়রাও কিনে থাকেন।
বৈশাখে শহর ও গ্রামে চুড়ি ব্যবসায়ীরাও বাড়তি আয় ঘরে তোলেন। ফুলের মালার দোকানগুলোয় ব্যাপক ভিড় লাগে। মেয়েদের বৈশাখী গহনার মধ্যে প্রাধান্য পায় কাঠ, পুঁতি, মাটি, বাঁশ ও ধাতুর তৈরি গহনা। এর সঙ্গে প্লাস্টিক ও কাঠের বোতাম ও সুতার তৈরি নানা ডিজাইনের কানের দুল ও গলার মালা। নারকেলের মালা, পাট ও পাথরের তৈরি কানের দুল অনেকের পছন্দ। বৈশাখে সব নারীই এসব গহনা পরে বের হন। এগুলো প্রস্তুতকারী ও বিক্রেতারা একটু বাড়তি আয়ের সুযোগ পান বৈশাখে।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে তরুণরা আলপনা এঁকে দিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। আগ্রহীদের কপালে ও গালে নববর্ষের সুন্দর কথার আলপনা এঁকে দেন। আলপনায় শিশু ও নারীদের আগ্রহই বেশি। যারা আঁকেন তাদের আয়টাও ভালোই হয়। খুশি হয়ে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত আলপনাকারীদের দিয়ে থাকেন।
বৈশাখে উপহারসামগ্রীর বিক্রিও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এর মধ্যে শুভেচ্ছা কার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজাদ প্রডাক্টস, আইডিয়াল প্রডাক্টসসহ বিভিন্ন শুভেচ্ছা কার্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। ইদানীং বৈশাখী উপহার হিসেবে প্রযুক্তিপণ্য দেয়ার চল শুরু হয়েছে। প্রিয়জনকে মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা, পেনড্রাইভসহ অনেকে ল্যাপটপও দিয়ে থাকেন। বর্তমানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার রমরমা প্রচারণায় বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাই চৈত্র মাস শুরুর পর থেকে কি গ্রাম, কি শহর সর্বত্রই বাংলা নববর্ষকে বরণের লক্ষ্যে বাংলার ঘরে ঘরে নানা আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি ও বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজের নববর্ষের পোশাকে সাজের আয়োজন দেখেই বোঝা যায় বাংলা নববর্ষ যেন জাগ্রত দ্বারে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সেই গান যা অবধারিতভাবে এখন বাংলা নববষের্র থিম সং হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই কালজয়ী গান বৈশাখ এলেই সবাই গুনগুন করে একবার হলেও গায়—
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বছরের আবর্জনা যাক মুছে যাক/যাক যাক, এসো এসো।’
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, জাপানে বাংলাদেশের ভূতপূর্ব বাণিজ্য দূত