অভিবাসীর উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। যদিও রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে অষ্টম। গত বছর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। যদিও একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অভিবাসীর উৎস দেশ হিসেবে অবস্থানে পিছিয়ে থাকলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে শীর্ষের দিকে রয়েছে অনেক দেশ। এ পরিসংখ্যান একটা বিষয় মোটাদাগে সামনে নিয়ে আসে—যে পরিমাণ জনশক্তি বিদেশে যাচ্ছে সে তুলনায় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অদক্ষ জনশক্তি রফতানির বিষয়টি সর্বাধিক আলোচিত। তবে এর পাশাপাশি অন্যতম কারণ হলো অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী, রিক্রুটিং এজেন্ট বা দালালের মাধ্যমে বৈধভাবে বিদেশে গিয়েও কাজ না পাওয়া এবং দেশে ফিরে আসা। পরিতাপের বিষয়, বৈধ পথে বিদেশগামীদের তথ্য বিশ্লেষণ করা সংস্থা বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কাছে বিদেশগামীদের সংখ্যা থাকলেও ফেরত আসা প্রবাসীদের কোনো তথ্য থাকে না।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্যের ভিত্তিতে বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ হয়ে আউটপাস নিয়ে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭০ বাংলাদেশী দেশে ফিরেছেন এবং বৈধ পথে বিদেশ গিয়ে অবৈধ হয়ে ফিরে আসাদের এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। ফেরত আসা শ্রমিকদের প্রতিজনের গড় ব্যয় ৫ লাখ টাকা ধরা হলে প্রবাসী পরিবারের মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ মূলত দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্টদের পকেটে গেছে। সবচেয়ে বেশি ফেরত পাঠানো হয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান ও কুয়েত থেকে। এতে যেমন প্রবাসী ও তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরূপ প্রভাবে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এছাড়া বৈদেশিক শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসার ঝুঁকিও বাড়ছে।
এমনিতেও এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশসহ মালয়েশিয়া বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, অবৈধ অভিবাসন ও অদক্ষ শ্রমশক্তি ছিল এর অন্যতম কারণ। এছাড়া অভিবাসীরা সেসব দেশে প্রতিশ্রুত কাজ না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে রাস্তাঘাটে এমন সব কাজ করতেন, যা সেসব দেশের প্রচলিত আইনে বিধিসম্মত নয়। অনেকে বাধ্য হয়ে অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়েন। আবার অনেকে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সেখানে অবস্থান করেছেন কিংবা শ্রমশক্তি প্রয়োজন না থাকার পরও সেসব দেশে দালালদের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন, বিদেশ থেকে ফেরত পাঠানো এসব কর্মী সরকারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই বৈধ পথে গিয়েছিলেন। কিন্তু যাওয়ার পর তাদের অনেকে বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ হারান। এরপর তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া বিদেশে অবস্থান অব্যাহত রেখেছিলেন। অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েও এমন অবস্থায় পড়েন। আবার বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও কাজ না পেয়ে ছয় মাসের মধ্যে দেশে ফেরার ঘটনা রয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) মতে, দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসন খাতকে নিয়মের মধ্যে আনা যায়নি। এটি একটি শ্রেণীর কাছে অর্থ লুটপাটের উপায়। এ বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ হয়ে যাওয়া প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারই দেশে ফেরার সুযোগ করে দেয়। নিয়োগকারী অথবা কোম্পানি টিকিট কেটে কর্মীদের দেশে পাঠিয়ে দেয় অথবা কর্মী নিজেই টিকিটের খরচ বহন করে। এভাবে দেশে ফেরত আসা কর্মীদের বেশির ভাগেরই দরকারি ডকুমেন্টস নেই। অনেকে কাজ পাননি, কারো ভিসা-পাসপোর্ট কিছুই নেই। আবার অনেকে অপরাধ করায় দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। মূলত এভাবেই প্রতি বছর হাজার হাজার প্রবাসীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এমন বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক শ্রমবাজার ধরে রাখতে রিক্রুটিং এজেন্ট, দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন কর্মসংস্থান যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে জনশক্তি প্রেরণ। এতে একদিকে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অন্যদিকে কাজ না পেয়ে কোনো প্রবাসীকে ফেরত আসতে হবে না। সর্বোপরি এজন্য সরকারের তদারকি জোরদার করতে হবে।
এ সংকট মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাও বটে। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই অধিকাংশ সময় গমন করেন। কিন্তু বিদেশে পৌঁছে যদি তারা প্রতিশ্রুত চাকরি না পান, আকামা না হয়, এমনকি কাজ ছাড়া বসিয়ে রাখা হয়, তাহলে দায়টা মোটেও শ্রমিকের হতে পারে না। এটা স্পষ্টভাবে দেখায় যে নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জায়গায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের পাঁচ গুণ বেশি খরচ করে বিদেশ পাড়ি দেয়াটা দুর্নীতির জায়গাকেও প্রতিফলিত করে। এ চক্র থেকে বের হওয়া প্রবাসী শ্রমিকরা প্রতি বছর দেশে যে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান, সেটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ধরে রাখতে বড় ভূমিকা রাখে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স। অথচ তাদের বড় অংশই নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে জেল খেটে, জরিমানা দিয়ে বা নিঃস্ব অবস্থায় ফিরছেন। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
অভিবাসন প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি স্বচ্ছ, নিরীক্ষিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে, যাতে প্রতিটি শ্রমিক নিজের ভিসা, চাকরির চুক্তি, রিক্রুটিং এজেন্সির তথ্য এবং খরচ যাচাই করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বিদেশে কাজের নিশ্চয়তা ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায়। এছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা প্রয়োজন। প্রতি বছর নির্দিষ্টসংখ্যক এজেন্সির কার্যক্রম মূল্যায়ন করে তাদের লাইসেন্স নবায়ন বা বাতিল করা যেতে পারে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যারা এ খাত তদারকি করবে।
এসবের পাশাপাশি বিদেশফেরত শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি দরকার। আর্থিক সহায়তা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও উদ্যোক্তা সহায়তা প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। এতে তারা নিজেরা আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবেন।