করোনা মহামারী খুব সহজে আমাদের ছেড়ে যাবে বলে মনে হয় না। এই মহামারীকে সাথে নিয়ে কীভাবে জীবন চলতে হবে তা আমাদের শিখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এটা শুধু মুখের বানী হয়ে থাকলে চলবে না, তা বাস্তবে পরিপালিত হতে হবে। অর্থনীতির ধাক্কা যেমন সামাল দিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে তেমনি জীবনকে আবার তুচ্ছ জ্ঞান করা চলবে না। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন ধারা এরই মধ্যে গজিয়ে উঠছে। দেশে দেশে জাতীয়বাদী মনোভাব মাথাচাড়া দিচ্ছে। উন্নত, অনুন্নত সবাই নিজের কভিড পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাবার আপ্রাণ চেস্টায় রত। তাই নিজেদের জন্যই তারা ভাবছে।
কভিডের প্রথম দিকে আশা করা হয়েছিল তিন থেকে চারমাসের মধ্যে এটা চলে যাবে আর অর্থনীতি আগের জায়গায় ফিরে আসবে। কিন্তু ৬ মাস পেরিয়ে যাবার পরও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘুরে দাঁড়ানোর খুব একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ব্যপারটি আরও ঘনীভূত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশে দেশে হাজার হাজার লোকের চাকরী গেছে। শিল্প উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আমদানি-রফতানি কমে তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে। এয়ারলাইন্স ব্যাবসা চরম মার খাচ্ছে। পর্যটন বলে কিছু ছিল বলে মনে হচ্ছে না। এই অবস্থায় অর্থনীতি কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তা নিয়ে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজ চিন্তকদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। কবে কভিড যাবে -তা নিয়ে কোন ভবিষ্যৎ বাণীই ঠিক থাকছে না। টিকা আবিস্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ কোন পরিকল্পনায় যেতে পারছে না।
অনেক দেশেই তাই লকডাউন তুলে দেয়া হচ্ছে, পরিণতিতে আবারও সংক্রমণ বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়া নূতন হটস্পুট হতে যাচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে। সুতরাং আমাদের টিকা আবিস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তো বটেই। কিন্তু আয় থাকুক আর নাই বা থাকুক খাদ্যের চাহিদাতো থাকবেই। তাই খুব দ্রুত অর্থনীতিকে আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে এমন চিন্তা পরিহার করে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর পথ বের করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষি অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে।অনেককাল ধরে অবহেলার কারণে কৃষি গুরুত্ব হারিয়েছে। দ্রুত উন্নতি করতে যেয়ে দেশগুলো শিল্প উৎপাদনে ঝুঁকছে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়ে গেছে। অনেক পরিবেশবাদীগণ বলছেন আজকের কোভিড মহামারী প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। এটা প্রকৃতির একটা শিক্ষা হতে পারে। প্রকৃতির কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। প্রকৃতি থেকেই খাদ্য আহরণ করতে হবে। প্রকৃতিকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে আর উন্নয়ন নয়। নৃশংসতা পরিহার করতে হবে।
টিকা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে। অতি মুনাফার লোভ সংবরণ করতে হবে। দেশে দেশে কৃষি উৎপাদনের উপর জোর দিতে হবে।মানুষ বাঁচানোর লক্ষ্যকে প্রধান ধরে সামনে এগুতে হবে। জোর করে অর্থনীতি চালাতে যেয়ে আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয় তা বিবেচনায় নিতে হবে। কভিডের পরীক্ষা কমিয়ে নয় বাড়িয়ে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নয়তো জাপান, কোরিয়া, ইতালি ইত্যাদি দেশের মত যদি একে একে আকাশ পথ বন্ধ হয়ে যায় তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার দীর্ঘায়িত হবে বলেই অর্থনীতিবিদ এবং জনস্বাস্থ্যবিদগণ মনে করছেন।
কভিড ক্ষত অর্থনীতির পুনঃরুদ্ধারে ধৈর্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে পরীক্ষা, পরীক্ষা আর পরীক্ষার দিকে মনযোগ দেয়াই যুক্তিযুক্ত। মানুষের মৌলিক খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষিতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বিদেশ ফেরত, চাকরি হারানো জনগোষ্ঠীকে কৃষিতে আপাত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া উত্তম বিকল্প হতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি মানুষকে এই কাজে সংযুক্ত করতে হবে। সরকারি কর্তাব্যক্তিদের এই কাজের সাথে পরিপূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। তদুপরি কভিডের সাথে পথ চলার ব্যবস্থাটাকেও আয়ত্ত করে নিতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হবে।
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক