ভারতেও ছড়াল এইচএমপিভি ভাইরাস

বাংলাদেশকেও সতর্ক হতে হবে

হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) একটি শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যা ফ্লু বা ঠাণ্ডাজনিত উপসর্গ সৃষ্টি করে। এ ভাইরাস বয়স্ক, ছোট শিশু ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্নদের মধ্যে ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করে।

হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) একটি শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যা ফ্লু বা ঠাণ্ডাজনিত উপসর্গ সৃষ্টি করে। এ ভাইরাস বয়স্ক, ছোট শিশু ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্নদের মধ্যে ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করে। এটি রেসপিরেটরি সিনসিশিয়াল ভাইরাস (Respiratory Syncytial Virus-RSV)-এর মতো একই গোত্রের অন্তর্গত। ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে এ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সাধারণত শীতের মৌসুমে বেশি দেখা দেয়। বর্তমানে চীনে এইচএমপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। এটি কয়েকশ বছর ধরেই মানুষকে সংক্রমিত করছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে এইচএমপিভি ভাইরাস উত্তর চীনে অনেক শিশুকে সংক্রমিত করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, চীনের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও গত সোমবার পর্যন্ত পাঁচটি শিশুর দেহে এ ভাইরাস পাওয়া গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশ, ভেজাল খাদ্য, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি থাকায় এইচএমপিভি ভাইরাসের প্রকোপ বেশি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর। এর ফলে শুধু ভাইরাস নয়, কয়েক বছর ধরে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। যেহেতু বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্বসহ নানা সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে, তাই এ দেশে ভাইরাসটির মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

গত ৬ জানুয়ারি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হেলেন ডেভিডসনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এইচএমপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে মানুষ আগে থেকেই অবগত। এ ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ছাড়া এ মুহূর্তে তেমন কিছু করার নেই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যেতে পারে। এ ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। যদিও কিছু টিকা তৈরিতে কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাস কয়েক দশক পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকায় কভিড-১৯-এর মতো এত গুরুতর নয়। যেহেতু বিশ্বের মানুষ আগেই এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে তাই তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা রয়েছে। তবে কভিড-১৯ ছিল একটি নতুন ভাইরাসজনিত রোগ, যা আগে কখনো মানুষকে সংক্রমিত করেনি। ফলে এটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে। যদিও এইচএমপিভি ভাইরাসের মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে এর সংক্রমণের বৃদ্ধি এবং এর প্রভাব গুরুতর। যেহেতু এইচএমপিভি ভাইরাসের কোনো টিকা বা প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, তাই কভিড-১৯ থেকে শিক্ষা নিয়ে এর প্রাদুর্ভাব কমাতে আমাদের কাজ করতে হবে। কভিডের সময় মানুষ সংক্রমণ কমাতে ভালো সতর্কতা অবলম্বন করেছিল। কিন্তু এখন তারা সে রকম কোনো সতকর্তা অবলম্বন করছে না। ফলে এইচএমপিভি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে কভিডের মতো কঠোর নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করতে হবে না। তবে আমাদের বাসায় অবস্থান করার পাশাপাশি সঠিকভাবে কাশি ও হাঁচির শিষ্টাচারগুলো অনুসরণ করা জরুরি। শীতের মৌসুমে বাইরে যাওয়ার আগে মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং স্যানিটাইজেশন করা উচিত। আক্রান্ত ব্যক্তিকে অসুস্থ অবস্থায় কর্মক্ষেত্রে যাওয়া পরিহার করা উচিত। যদি কর্মক্ষেত্রে বা জনাকীর্ণ এলাকায় যেতেই হয় তাহলে অবশ্যই তাকে মাস্ক পরিধানসহ পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া উচিত। যাতে অন্য কেউ, বিশেষ করে যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, তারা যেন সংক্রমিত না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

যেকোনো ধরনের ভাইরাল ইনফেকশনই আমাদের জন্য মারাত্মক। জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় অনেক বেশি। বর্তমানে বাসস্ট্যান্ড, হাটবাজার, বস্তি, যানবাহন ও হাসপাতাল এমনকি অফিসে মানুষের আনাগোনা বেশি। যেখানে মানুষ বেশি থাকে সেখানে একজনের নিশ্বাস খুব সহজেই আরেকজনের শরীরে প্রবেশ করছে। তাই মেট্রোরেলসহ পাবলিক বাস ও জনবহুল এলাকা বিশেষ করে হাসপাতালে এসব বিষয়ে সতর্কতা পালন করা খুব জরুরি। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ায় ভারতে যেহেতু ভাইরাসটি ছড়িয়েছে, তাই পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য আগে থেকেই আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এছাড়া যেসব এলাকায় শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী মা ও আগেই থেকেই যাদের নানা রোগ রয়েছে, তাদের শীতকালে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

কভিড-১৯ মহামারীর সময় আমরা মাস্ক পরেছি, মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেছি, হাঁচি-কাশির সময় হাত বা কনুই দিয়ে মুখ ঢেকেছি। কিন্তু এখন সেই কৌশলগুলো তেমন অনুসরণ করা হচ্ছে না। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সেসব কৌশল অনুসরণ করা অত্যাবশ্যকীয়। ভাইরাসটি হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে দ্রুতগতিতে ছড়ায়। এর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগবালাই তো রয়েছেই। সবকিছু মিলিয়ে ভাইরাসটি আমাদের দেশে ছড়ানোর খুব সম্ভাবনা রয়েছে। এটি যেহেতু ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগেরই একটি ভাইরাস, খুব স্বাভাবিকভাবেই এর মাধ্যমে আমরা আক্রান্ত হতে পারি।

যেকোনো ভাইরাসের বিষয়ে ম্যাপিংসহ নিয়মিত নজরদারি থাকা দরকার। কারণ নজরদারিতে কিছু বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এখানে ইমার্জিং ও রি-ইমার্জিং যেসব রোগ রয়েছে সেগুলোর একটা ডাটাবেজ থাকা উচিত। পাশাপাশি জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে। জনবহুল এলাকায় মানুষকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। তা না করতে পারলে আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি হবে। তাছাড়া বর্তমানে কে আক্রান্ত হচ্ছে বা হয়নি তা কারো জানা নেই। এজন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। মেট্রোরেলসহ পাবলিক বাস ও জনবহুল এলাকা, বিশেষ করে হাসপাতালে এসব বিষয়ে সতর্কতা হিসেবে মাস্ক পরিধান করা খুব জরুরি।

শীতের সময় এমনিতেই অনেক ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যায়। এ সময় প্যাথোজেনগুলো ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ থাকে। আর এ সময় মানুষের শরীরও কিছুটা সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। তাই এ সময়ে একটু বেশিই সতর্কতামূলক পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে নিপাহ ভাইরাসের কথা বলা যেতে পারে। ভাইরাসটি শীতের সময় বাঁদুড়ের সাহায্যে বেশি ছড়িয়ে থাকে। কিছু ভাইরাস শীতের সময় বেশি ছড়ায়, আবার গরমের সময় তা কমে যায়। ফলে বছরজুড়ে ম্যাপিং থাকলে কোন এলাকায় ও কখন নির্দিষ্ট কোন ভাইরাস বেশি ছড়িয়ে থাকে সে বিষয়ে স্পষ্ট একটি ধারণা থাকবে।

কেউ যদি সংক্রমিত হয়ে যায় তাহলে তার তো আইসোলেশনের দরকার হতে পারে। যেহেতু এ ভাইরাস সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়, সেক্ষেত্রে রোগীদের হাসপাতালে গাদাগাদি করে রাখলে বরং আরো বেশি বিপদ হতে পারে। এমনিতেই আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীর ভিড় যথেষ্ট বেশি। পর্যাপ্ত আসন ও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় গাদাগাদি করে রোগীদের থাকতে হয়। এমনকি ওয়াশরুমের দরজার কাছেও থাকতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের বেশি পরিমাণে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। এজন্য জনসচেতনতায় প্রচারণা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করতে পারে এর মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এ অবস্থার তৈরি না হলে সাধারণ মানুষ সচেতন হবে না।

আরও