বিশ্বের অগ্রগণ্য অর্থনীতির একটি দেশ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। তবে তার জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। এক্ষেত্রে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়ের আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সে সময়ে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি লাভ করছিল, যা কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকার চেয়েও বেশ ভালো ছিল বলে অনেকে মনে করেন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে চলেছে লাতিন আমেরিকার দেশটি। কিন্তু সব ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে পরবর্তী কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে গেল, আর আর্জেন্টিনা পিছিয়ে পড়ল। কারণটি অনেকটাই স্পষ্ট—যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা ও গবেষণায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছিল, যা আর্জেন্টিনা করেনি। আর্জেন্টিনা অর্থনীতির সূচকের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে সারা বিশ্বের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবাস এখন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, দেশটিতে বিশ্বের জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের আনাগোনা এবং তারা সেখানে অবস্থান করছেন। কারণ দেশটি গবেষণার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। শিক্ষায় অনেক এগিয়ে তারা। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় দক্ষিণ কোরিয়ার উত্থানের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সত্তরের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় একই ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল বছরে যথাক্রমে ১২৮ মার্কিন ডলার ও ২৯০ মার্কিন ডলার। সেখানে ২০২৩ সালে এসে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের ১৬ গুণেরও বেশি। দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার এত ব্যবধানের পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা হলো শিক্ষার প্রতি গুরুত্বের তারতম্যের। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পেটেন্টের অধিকারী দেশের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া এখন চতুর্থ। পেটেন্টের দিক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র; তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপান। তবে মাথাপিছু পেটেন্টের দিক থেকে দক্ষিণ কোরিয়াই প্রথম। দেশটির প্রতি দশ লাখ নাগরিক পিছু পেটেন্টের সংখ্যা ৩৩১৯টি; জাপানে এই সংখ্যা ১৯৪৩। কিছুদিনের মধ্যেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের হিসাবেও জাপানকে টপকে যাবে দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাপানের মাথাপিছু আয় ছিল ৩৯ হাজার ৬৮৩ মার্কিন ডলার আর দক্ষিণ কোরিয়ার ৩৪ হাজার ৯৪০ ডলার। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ই শিক্ষায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তার সুফল তারা পাচ্ছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে রাষ্ট্র শিক্ষাকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে, তার ওপর দেশের আর্থিক ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের যুগে কাজের ধরন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। একে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিল্প বিপ্লবের প্রতিটি পর্যায়েই উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোনো না কোনো ধাপে শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এতে প্রথম দিকে কর্মসংস্থান হ্রাস পেলেও নতুন নতুন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে কী ঘটবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তার জন্য প্রযুক্তিও থাকতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে উন্নত দেশগুলোতে জিডিপি ও শ্রমিকদের মজুরির অনুপাত হ্রাস পেতে শুরু করে। তবে বাংলাদেশের বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে মজুরির হার এতই কম যে হয়তো আগামী কয়েক বছর এখানে যন্ত্র এসে মানুষের কাজ দখল করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এমন একটা সময় আসবে যখন বাংলাদেশে যন্ত্রই বেশির ভাগ প্রথাগত কাজ করবে। কারণ যন্ত্রের দক্ষতা মানুষের চেয়ে বেশি হবে, অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলেও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সুতরাং ভবিষ্যতে মানুষকে এমন কাজের জন্য তৈরি হতে হবে, যে কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সহজে করা যাবে না। তার জন্য শিক্ষার ধরন পরিবর্তন করতে হবে, প্রচলিত মুখস্থবিদ্যার বাইরে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল করে তুলতে হবে। তার জন্য যেমন শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে তুলতে হবে। এর জন্য সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছা জরুরি। দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কুল পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন অনেক আকর্ষণীয়। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন অতি উৎসাহে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে তার প্রভাব প্রবাহিত হচ্ছে। তার বিপরীতে বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগেই দুর্নীতি হচ্ছে। যোগ্যতার বদলে অনেকে অর্থ দিয়ে বা ক্ষমতার জোরে শিক্ষক হচ্ছেন। এতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। আর যাই হোক অযোগ্য শিক্ষকের পক্ষে উন্নত শিক্ষাদান করা সম্ভব নয়। সেই শিক্ষকের পুরো কর্মজীবনটাই রাষ্ট্রের একটি বোঝা ও সম্পদের অপচয় বৈ কিছু নয়।
উন্নত দেশগুলোর অনেকেরই অর্থনৈতিক সাফল্যের বড় কারণ সেই দেশগুলোর শিক্ষার প্রভূত অগ্রগতি। তাই প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের সরকার শিক্ষা সম্প্রসারণকে তাদের কর্মসূচির একেবারে কেন্দ্রে স্থান দেয়। বাংলাদেশের সরকারও সেই দলেই পড়ে। বস্তুত গত কয়েক দশকে যে রাজনৈতিক দলই সরকার গড়েছে, তারা প্রচুরসংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করেছে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির জন্য। শিক্ষা সম্প্রসারণে বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান, নারী শিক্ষা সম্প্রসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ, যেটি বেড়ে ২০২২-এ ৭৪.৬৬ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। এ কারণে দেশের জনসম্পদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ।
পরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। শিক্ষা একটি দেশের অর্থনীতিতে মানব পুঁজি তৈরি ও জোগান দিয়ে থাকে। যা অর্থনৈতিকভাবে কৃষি, শিল্প, সেবাসহ অন্যান্য সামাজিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পিত শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যোগসূত্র রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। পরিকল্পিত শিক্ষা ইউরোপীয় উন্নত অর্থনীতির দেশ ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। নারী ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করে পরিকল্পিত শিক্ষা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর গতিধারা, পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও শিক্ষাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে স্বীকার করেন এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি করে এরূপ শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা একটি জাতিকে কীভাবে পাল্টে দেয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। বহু আগেই জাপান শিক্ষাকে বিশাল পুঁজিতে রূপান্তরিত করেছে। ৯৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় শতভাগ শিক্ষিত জাপানিদের অর্থনৈতিক সম্পদের মধ্যে ১ শতাংশ প্রাকৃতিক পুঁজি, ১৪ শতাংশ ভৌত ও বস্তুগত পুঁজি এবং ৮৫ শতাংশ শিক্ষাসংক্রান্ত মানবিক ও সামাজিক পুঁজি। বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে শিক্ষায় বিনিয়োগের রেট অব রিটার্ন অনেক বেশি। বর্তমানে আমরা সবাই জানি ও অনুধাবন করি যে একজন শিক্ষিত শ্রমিক অপর অল্পশিক্ষিত বা শিক্ষাবিহীন শ্রমিকের চেয়ে বেশি আয় করেন। তাই আমাদের অভিভাবকরা শিক্ষার প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী। গবেষণায় দেখা যায়, মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার আয়কে ৫ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথও শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে শিক্ষাকে মূলধন হিসেবে গণ্য করেছেন। আবার অনেকে মনে করেন শিক্ষা হচ্ছে সু-অভ্যাস গঠন, আত্মোন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা, নৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ জাগরণের উপায়। তাদের কথা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প নেই, সেটি বাংলাদেশের জন্যেও সত্য। তবে তার জন্য শিক্ষাকে হতে হবে মানসম্পন্ন। সাধারণত শিক্ষিত ও দক্ষরা বেশি উপার্জন করে তাই শিক্ষার মাধ্যমে অসাম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। পাঠ্য বইয়ের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে বা কর্মজীবনের সঙ্গে সমন্নয় করতে হবে। শিক্ষাকে দেশের অর্থনীতি ও সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে একুশ শতকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনমুখী ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে টেকসই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা