অভিমত

স্বাধীনতার অপব্যবহার এবং শিক্ষা

বিপ্লব বলুন আর অভ্যুত্থান বলুন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল জনজীবনে ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা আর স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা। আমরা কিন্তু চিরকাল বিপ্লব এবং রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য

বিপ্লব বলুন আর অভ্যুত্থান বলুন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল জনজীবনে ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা আর স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা। আমরা কিন্তু চিরকাল বিপ্লব এবং রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য অভ্যুত্থানে অংশ নিইনি। আমরা চেয়েছি অসংগতি দূর করে শান্তিতে জীবনযাপন করতে। কিন্তু একদিকে দেখছি অটো পাসকামীদের অতর্কিত আন্দোলন, আবার অন্যদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বয়ক গোষ্ঠীর হুংকার। একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্বজননির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং বিপদগ্রস্ত জনজীবন। আমরা ক্ষিপ্ত, হিংস্র হয়ে উঠছি, বিচারিক প্রক্রিয়ার তোয়াক্কাও করছি না। পরিবর্তন চাওয়া গণমানুষের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে যথেচ্ছ নিয়ম ভাঙার হিড়িক, নিয়মে ফেরার অনীহা অথবা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে আমাদের আন্দোলন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য নয়।

আলোচকরা মনে করছেন যে এ সরকারের ব্যর্থতা কামনা করেন এমন একজন নাগরিকও নেই, কিন্তু তিন মাসে এ সরকারকে সঙ্গে নিয়ে সংস্কারের পথে আমরাও কতটা হাঁটতে পেরেছি, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সবাই মিলে সিস্টেম সংস্কার সত্য সত্যই আমরা চেয়েছি কিনা নতুন পাওয়া স্বাধীনতার যথেচ্ছ অপব্যবহারের উদাহরণগুলো বারবার আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কেন আমাদের আচরণ এমন? স্বাধীনতা বলতে আমরা আসলেই কী বুঝি? স্বাধীন দেশের নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়? শিক্ষা কীভাবে আমাদের দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে নির্মাণ করার প্রধান হাতিয়ার হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর আলাপ এবং আত্মসমালোচনা করতেই তড়িঘড়ি করে লিখতে বসা।

স্বাধীনতাকে কবি শামসুর রাহমান বলছেন, ‘‌যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’, বটে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশী হিসেবে স্বাধীনতা বলতে কী বুঝি এমন কাজ খুব বেশি চোখে পড়ে না, যেমনটি পড়ে পশ্চিমা চিন্তাবিদ ও বিশ্লেষকদের লেখায়। যেমন হেগেল বলছেন আত্মোপলব্ধির কথা, স্টাইনার বা অমর্ত্য সেনরা স্বাধীনতা বলতে বুঝিয়েছেন পছন্দ করার স্বাধীনতা। হাইডেগার বলছেন, নিয়মের মধ্যেই মুক্তি। আমাদের চিন্তক আকবর আলি খান যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও ক্ষমতায়নকে স্বাধীনতা হিসেবে দেখছেন। সেই স্বাধীনতা আমরা অর্জন কীভাবে করতে পারি তার আলাপ রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা নিয়ে আমরা কী করব, সেটি অনেকটাই উহ্য। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে স্বাধীনতা মানে যতটা যথেচ্ছ আচরণ তার থেকেও অনেক বেশি দায়িত্বশীলতা এবং এ দায়িত্বশীলতার উৎস যৌক্তিক চিন্তা।

আমাদের জাতীয় চর্চায় দায়িত্বশীলতাকে অনেকাংশে নিয়মনীতির শৃঙ্খল হিসেবে দেখা হয়, একটি সিস্টেমকে আমরা নাগপাশ বন্ধন মনে করি। খুব সহজ দুটি উদাহরণ নিই: টিকিট কিনতে লাইন বজায় রাখা আর ট্রাফিক আইন মেনে চলা। আমি মনে করতে পারি না শেষ কবে সুসংবদ্ধ একটি লাইন দেখেছি। আর ঢাকার রাস্তায় বেশির ভাগ যানজট সৃষ্টির কারণ মনে হয়েছে নিয়ম অমান্য করা। আমি যানজটে বসেই আমাদের মনস্তত্ত্বটি বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা অধৈর্য, অসহিষ্ণু, অশ্রদ্ধাশীল ও অযত্নশীল। আমরা নিজেদের প্রতি সৎ নই, অন্যদের বেলায় তো প্রশ্নই আসে না। আমি ভাবছি লাইন বা আইন ভেঙে জীবনযুদ্ধে বুদ্ধি খাটিয়ে আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম, কিন্তু সবাই মিলে আইন ভাঙা যে নৈরাজ্য, অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়, এটি আমরা ভুলে যাই। কোনো দাপ্তরিক কাজে গেলে আমরা সবার আগে দুই নম্বর পদ্ধতিটি খুঁজে বের করি। অর্থ আত্মসাৎ করেনি, দুর্নীতি করেনি—এমন সরকার আমরা কখনো দেখিনি। অন্যকে ঠকিয়ে আমি ‘‌খুব জিতে গেলাম’ ভেবে বসে থাকি, কিন্তু তাতে যে সামষ্টিকভাবে আমরা সবাই হেরে যাই, এটি মনে থাকে না। সুদূরপ্রসারী ভালোর চেয়ে আমাদের বেশি পছন্দ স্বল্পমেয়াদি বা তাৎক্ষণিক অর্জনের দিকে, তা যদি বিনা পরিশ্রম এবং বিনা অপেক্ষায় হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। অর্থাৎ আমরা দূরদর্শীও নই, দূরদর্শিতার তেমন প্রয়োজনও বোধ করি না। কারণ আমরা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে বের করতে পারি না যে অনিয়ম একটি সিদ্ধান্ত আমার নিজেরই ক্ষতি সাধন করছে। তাই স্বাধীনতা বলতে আমরা বুঝি নিয়ম অগ্রাহ্য করার স্বাধীনতা—স্বেচ্ছাচারিতা।

পাঠক মনে করতে পারেন কি, মাস তিনেক আগে আমরা বিগত সরকারকে উৎখাত করার জন্য কেন উঠেপড়ে লেগেছিলাম? তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরাচারী আচরণ। বিগত সরকার একপাক্ষিকভাবে কেবল নিজের আখের গোছানোর কথা ভেবেছে, আমাদের কথা ভাবেনি, এটুকু আমরা বুঝে গিয়েছি এবং আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আত্মসমালোচনা কষ্টের কিন্তু আমরা নিজেরাও কি কেবল নিজের তাৎক্ষণিক লাভের কথা ভেবেই কাজ করি না? আমরাও কি স্বেচ্ছাচারী নই? রাস্তায় যাওয়ার সময় খাবারের ঠোঙাটা ফেলে দিয়ে চলে যাই না? এগিয়ে থাকার জন্য অযৌক্তিকভাবে লেন পরিবর্তন করে দীর্ঘ সময়ের জন্য যানজট সৃষ্টি করে নিজেই সেখানে আটকে থাকি না? অস্বীকার করার উপায় আছে? আমরা অন্যের প্রতি যত্নশীল ও শ্রদ্ধাশীল নই, তাই নিজেও যত্ন ও সম্মান পাই না। আমি একজনকে ঠকাই, আরেকজন আমাকে ঠকায়। এভাবে আমরা নিজেরাই কি নিজেদের ধ্বংসের গর্ত খুঁড়ছি না?

তাই বলছি, আমরা স্বাধীন নই। একজন স্বৈরাচারীকে হটিয়ে আমরা স্বাধীন হয়ে যাইনি। আমরা স্বেচ্ছাচারিতার দাস রয়ে গেছি। আমি এর প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছি প্রকৃত শিক্ষার অভাব। অনেকেই মনে করতে পারেন দেশে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে, ঝরে পড়ার হার কমেছে, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। কিন্তু এত ভালো ভালো সংখ্যাও আমাদের ছেলেমেয়েদের ঠিকঠাক পড়তে শেখাচ্ছে না, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে পারে, সরকারি চাকরির পরীক্ষায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী দিন-রাত স্কুল পর্যায়ের পড়া মুখস্থ করে! শিক্ষার ফলাফল যেখানে এমন, সেখানে আশা করা দুরূহ যে এ শিক্ষা আমাদের যৌক্তিক চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেবে। ‘‌আমি কি আমার কামনার দাস?’ আর ‘‌আমার সিদ্ধান্তের নির্বাচন কি যৌক্তিক?’—এ দুটি প্রশ্নই আমাদের সার্বিক উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে—আমাদের সততা শেখাবে, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া শেখাবে, সহমর্মিতা শেখাবে।

আপনি চিন্তা করে দেখেন, গত ৫৩ বছরে ধীরে ধীরে দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, সব সম্পদ চলে গেছে ১ শতাংশ মানুষের হাতে। অর্থাৎ আমরা ১ শতাংশ মানুষের তুলনায় দরিদ্র। লালনও দরিদ্র ছিলেন, তিনিও নিঃস্বের দলে। কিন্তু তিনি যে দর্শনের কথা বলে গেছেন, আমরা তেমন কিছু বলতে পারছি না। লালনের মাঝে এমন কি জোগান ছিল, যেটি থেকে আমরা বঞ্চিত? লালনের শিক্ষা, বোধ, অন্তর্দশন তাকে শোষণের বিপরীত পক্ষ হিসেবে তৈরি করেছে। তার পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও লালন প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং তা-ই ছড়িয়ে গেছেন—অন্যকে শ্রদ্ধা করার আর ভালোবাসার শিক্ষা। আর আমরা সমতার বালাই না রেখে ওই ১ শতাংশের অংশ হওয়ার দৌড়ে অংশ নিই! শোষণের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে, শোষকদের একজন হওয়ার জন্যে লালায়িত হই। আমরা চাইছি সবাইকে পেছনে ফেলে আমি এককভাবে জিতে যাব। বিন্দুমাত্র সামাজিক দায়বদ্ধতার বালাই না করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি—সামষ্টিক উন্নতি আমাদের উদ্দেশ্যই নয়। সমাজবদ্ধতা বর্জন করে সমাজহীন ব্যক্তিচিন্তার এ শিক্ষাই শোষণের শিক্ষা। তার পরিষ্কার প্রতিফলন আমরা আরো শোষক, প্রতারক, অধৈর্য, অসহিষ্ণু, স্বেচ্ছাচারী, অযৌক্তিক চিন্তার মানুষ তৈরি করছি।

প্রশ্ন থেকে যায় এ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কীভাবে শেখা যায়? তাহলে আমরাও কি সহমর্মিতা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর নির্ভর করা শুরু করব এবং স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেব, নাকি দৈব কোনো উপায়ের জন্যে চাতকের মতো বসে থাকব? সেটি মনে হয় খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং আনুষ্ঠানিক এবং সচেতন পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়া আমাদের হাতে কার্যকর আর কোনো উপায় নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনভাবে শোষণের শিক্ষা দেয়া বন্ধ করে সবার উন্নয়নের শিক্ষা দেয়া শুরু করলে ধীরে ধীরে মানবিক মানুষ বের হয়ে আসা শুরু করবে। যারা জোরজবরদস্তি করে নিজে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সবাই মিলে চলার চর্চা করবে। স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে। একজনের কারণে অন্যের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, সেই দায়িত্ব নিতে শিখবে। তারা সবাইকে মান দেবে, সে মান আপনি ফিরে পাবে। এটিই হবে শিক্ষার প্রকৃত ব্যবহার।

তাই যারা সংস্কার করতে চান, তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রটি খুব যত্ন করে সময় নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। স্বৈরাচার তৈরির কারখানা না বানিয়ে মানুষ বানানোর ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। মানুষের মাথায় অসততা, হিংসা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, অশ্রদ্ধা নিয়ে আপনারা একা সংস্কার করতে পারবেন না। মানুষের প্রতি যত্নশীল হওয়ার প্রমাণ হবে শিক্ষা নিয়ে গভীর চিন্তা। এর ফলাফল আমরা জীবদ্দশায় কতটুকু পাব তা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন সুন্দর করে তুলবে।

আজ যে ছেলেগুলো অটো পাসের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, তাকে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে শিখিয়ে দেয়নি যে ওই গণিত, বিজ্ঞান বা ভাষার জ্ঞানটুকু না থাকলে সে জীবনে শক্ত হয়ে বেড়ে উঠতে পারবে না। এর থেকে ভালো হয়, একটু দেরি হোক, তবু প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষা দিয়ে বের হোক। বিনা পরীক্ষায় পাস যে আদতে পাসই না, এটুকু তাকে কে বোঝাবে? বোঝানো সম্ভব না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব ছিল স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। তারা সেটি করতে না পারায় তাদের সরে যেতে হয়েছে। কিন্তু সেই একই ধারা বজায় রাখার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমরা আর অসততার দাম দিতে চাই না।

তাহলে সেই শিক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে করতে হবে? সরকার বা মন্ত্রণালয় যদি এককভাবে এ দায়িত্ব নেয়, তবে সব ভজকট লেগে যেতে পারে। একদল যোগ্য, দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শিক্ষা সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। নির্বাচন, পুলিশ, বিচার বা সংবিধানের সমপরিমাণ গুরুত্ব দিয়েই শিক্ষার জন্য নিবেদিত একটি কমিশন এখন খুব জরুরি। এমন একটি কমিশন যেটি শিক্ষাকে সরকারের শোষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করে মানবিক ও দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিতে পারবে। জাতির কাছে এ বার্তা পৌঁছাতে পারবে যে সুশিক্ষাই আমাদের মাঝে এমন মূল্যবোধ তৈরি করে দেবে, যেটি হবে জাতিগত সংস্কারের মূল হাতিয়ার।

আসিফ বায়েজিদ: শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম গবেষক, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য

আরও