অবসরপ্রাপ্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও সিনিয়র সচিবরা কি দরিদ্র? তারা কি অসহায়, সহায় সম্বলহীন? তারা কি দুস্থ আজকের দিনে? প্রশ্নটি কি মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে উঠেছে বলে করছি, না অন্য কোনো কারণ আছে? শুধু এ প্রশ্নই নয়। আরো প্রশ্ন আছে। ধরা যাক, কোন এক প্রৌঢ় ব্যক্তির দুই ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। দেশে রয়েছেন তারা বুড়ো-বুড়ি। সংসার চলে কীভাবে? স্ত্রীর নামে সঞ্চয়পত্র আছে—পরিবার সঞ্চয়পত্র যাতে সুদহার সামান্য একটু বেশি। প্রৌঢ়ের রয়েছে ব্যাংকে ব্যাংকে কিছু মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট)। এর ওপর কিছু সুদ পান নিয়মিত। হয়তো ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে মাঝেমধ্যে কিছু ডলার পাঠায়। বুড়ো-বুড়ি ছেলেমেয়ের পাঠানো টিকিটে দু-এক বছর পরপর বিদেশে যান। দৃশ্যত ভালোই আছেন অনেকের তুলনায়। একটা গাড়িও ছেলেমেয়েরা কিনে দিয়েছে। বর্ণনাটা একটু বেশি হয়ে গেল? তাদের ক্ষেত্রে প্রশ্ন তারা কি দরিদ্র? হতদরিদ্র? তারা কি অসহায়, সহায়-সম্বলহীন? এখানে মাত্র দুই শ্রেণীর লোক সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী যারা মাসে মাসে পেনশন পান, নিয়মিত পান। সরকার এদের পেনশন মাঝে মাঝেই বাড়ায়। মোটামুটি তাদের একটা অবিরাম ধারার পেনশন আছে। এমনকি তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের পোষ্যরা পর্যন্ত পেনশন পাবেন—এ হচ্ছে দেশের ‘সেবা’ করার প্রতিদান দেশবাসীর পক্ষ থেকে, সরকারের পক্ষ থেকে।
পরে উল্লেখিত শ্রেণীতে পড়েন অনেক বেসরকারি লোক। এদেরও একটা অবিরাম আয় আছে। মাসিক আয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের অবশ্য পেনশন বাদেও অন্য আয় থাকতে পারে এবং আছেও। অনেকে পাঁচ কাঠা জমি সরকার থেকে নামমাত্র মূল্যে পেয়ে ডেভেলপার দিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। নিজে থাকেন, দু-চারটা ভাড়াও দেন। এত কথার পর মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও মাননীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন: ওপরে উল্লেখিত দুই শ্রেণীর লোকেরা কীভাবে দরিদ্র, হতদরিদ্র, সহায়-সম্বলহীন লোক হিসেবে সরকারের খাতায় স্থান পায়? প্রশ্নটি অনেকের, আমারও। কোনো জবাব পাই না। কেন বলছি এ কথা। বলছি সাম্প্রতিক সময়ে একটি কাগজের প্রতিবেদন পড়ে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ‘পেনশনের টাকা’। সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদের টাকা নাকি ‘সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়’। তারা নাকি সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতাধীন লোক। কী অসম্ভব একটা ঘটনা। কী কারণে, কারা এ ঘটনা ঘটাচ্ছে জানা যাচ্ছে না। আরো আশ্চর্য হচ্ছি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বিচারিতা দেখে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাবে ভুল ধরেছে। আমাদের নাকি সংজ্ঞা ভুল। এ কথা বলে এখন সংজ্ঞা বদলিয়েছে। বাধ্য করেছে আমাদের তাদের সংজ্ঞানুসারে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ করতে। এমন অনেক ক্ষেত্র আছে, যার সংজ্ঞা সম্পর্কে তারা আমাদের পরামর্শ দিচ্ছে। আমরা তা মেনেও নিচ্ছি। শত হোক আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস যদি তাই হয় তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে কারা পড়বে, কারা পড়বে না তা ঠিক করে দিতে তাদের আপত্তি কোথায়? কাগজে দেখলাম তারা শুধু বলছে সামাজিক নিরাপত্তা/সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যথার্থ কথা।
বাজারের যে অবস্থা, মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বগতি তাতে অগণিত মানুষ নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে গরিব হচ্ছে। দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্র, সহায়-সম্বলহীন হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে তারা বলেছে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে। কিন্তু কীভাবে? এমন ধরনের অর্থাৎ পেনশনের টাকা, সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদের টাকা ইত্যাদি এ প্রকল্পে যোগ করে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি করা? জানি না। সরকার কী করতে যাচ্ছে। এমনিতে কাগজে দেখলাম পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদে যে ব্যয় ধরা হয় তা মোট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ক্রমেই বাড়ছে। মোট সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যা ব্যয় হয়েছিল ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তার ২৬ শতাংশ ছিল পেনশনের টাকা এবং সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত সুদের টাকা। এর পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছর হয়েছে ৩১ শতাংশ। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? মানে হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে ব্যয় দেখানো হচ্ছে, তার এক-তৃতীয়াংশ প্রকৃত সামাজিক নিরাপত্তা খাতের খরচ নয়। কীভাবে? উত্তর খুব সহজ। যেসব সচিব, অতিরিক্ত সচিব এখনো অবসরে যাননি, দুদিন বাদে যাবেন তারা নিজেরাই নিজেদের দরিদ্র, হতদিরদ্র বলে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন। অথচ এটা কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। শুনেছি বর্তমানের অর্থমন্ত্রী একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তিনি কি তাহলে দরিদ্র, অতিদরিদ্র শ্রেণীতে পড়েন? কেন এ লুকোচুরি?
কে না জানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা দেশ পরিচালনায় তাদের ‘অবদানের’ স্বীকৃতিস্বরূপ সারা জীবন পেনশন পান। মৃত্যুর পর তার পোষ্যরা তা পায়। এটা আমরা জানি, চাকরির শর্তের একটা অংশ। অনেক সরকারি চাকরিতেই পেনশনের সুবিধা রয়েছে। চাকরির শর্ত হিসেবে প্রাপ্ত পেনশন কারা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যোগ করে এ খাতে বরাদ্দকে স্ফীত করে দেখাচ্ছে? একই যুক্তি খাটে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রাপ্ত সুদের ক্ষেত্রে। এ সুদ বিনা কারণে হরেদরে সবাইকে দেয়া হচ্ছে না। সঞ্চয়পত্র কিনে যাদের সাড়া আছে। যাদের উদ্বৃত্ত কিছু টাকা আছে। এরা বিশালসংখ্যক ক্ষেত্রেই দরিদ্র বা হতদরিদ্র নয়। এ কথা কি সত্য নয়? যদি সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় হয়। তাহলে সরকারি ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত মেয়াদি আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় হওয়া উচিত নয় কি? ভিন্ন যুক্তিতে তো তাহলে বলতে হয় বেতন, ভাতা হিসেবে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রদত্ত টাকাও ‘সামাজিক নিরাপত্তা লাভের ব্যয়’। বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার কী যুক্তিতে দিনের পর দিন এ ‘প্র্যাকটিস’ চলছে তা পরিষ্কার করে বললে আমাদের আর লেখালেখির প্রয়োজন হয় না।
এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে পড়বে দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা। যেমন অসহায় বিধবা, সহায় সম্বলহীন বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারী। এ শ্রেণীর লোকেরাই এর আওতায় পড়বে। এটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। যারা খেতে পায় না, যাদের সংসার চলে না, যারা দুর্দিনে আছে, কষ্টে আছে, উপোস করছে তারাই থাকবে ‘সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে’। এখানে বলে রাখা দরকার সরকারি সংজ্ঞায় তারা দরিদ্র ও হতদরিদ্র। সরকার যে খানা জরিপ করে তাতে আমরা দেখি সরকার দরিদ্রের একই সংজ্ঞা অনুসরণ করে। কোনো ব্যক্তি যদি ২১২২ ক্যালরি খাবার পর কিছু টাকা খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ করে তাহলে সে দরিদ্র। আর ২১২২ ক্যালরি কেনার পর যদি কিছু না থাকে তাহলে সে হতদরিদ্র। এ হিসেবে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছে দেশে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ লোক এখনো দরিদ্র এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ লোক হতদরিদ্র। এখন প্রশ্ন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী যারা মাসে মাসে পেনশন পান তারা কি ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ অথবা ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে পড়েন? বড় প্রশ্ন। যদি পড়েন তাহলে তা ব্যাখ্যা করে বলা দরকার। আরো প্রশ্ন আছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে যেসব কর্মসূচি আছে তার জন্য খরচ বরাদ্দ আছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা। হিসাবেই দেখলাম এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদ। তার মানে ৪০-৪৫ হাজার কোটি টাকা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের খরচ নয়। বিনা কারণে আমাদের ‘সবজান্তা আমলারা’, ‘বাজেট কেরানিরা’ এ টাকাকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের খরচ হিসেবে দেখাচ্ছে। তার আর এক অর্থ হচ্ছে তারা নিজেরাই নিজেদের দরিদ্র হতদরিদ্র হিসেবে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন। নিজের প্রতি নিজেই অবিচার করে যাচ্ছেন।
কথা কি শেষ? না। পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন ডকুমেন্টেই দেখা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ টাকা যাদের পাওয়া উচিত তারা পায় না। অনেক প্রকল্পে ‘ডুপ্লিকেশন’ আছে। শত হোক শতাধিক কর্মসূচির অধীনে ২০-২৫টি মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব পালন করছে। না জানি কোন মন্ত্রণালয় কিসের টাকা কিসের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে। সরকারি কর্মকর্তারা অঘটনঘটনপটীয়সী। বিষয়টিকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। কিসের টাকা কিসের ভেতর লুকানো হচ্ছে। শুধু এ খাতের টাকা নয়, সমগ্র বাজেট প্রক্রিয়াটি আরো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। বহু জিনিস অস্পষ্ট, বহু জিনিস জবাবদিহিতাহীন। চলছে, চলবে—এই ভাব। কিছু বাজেট কেরানি আছে যারা যেভাবে বলা হবে সেভাবে বাজেটকে স্ফীত, সংকুচিত করে দেখাতে সক্ষম। এটা তাদের ‘মুনশিয়ানা’।"এসব থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার। বড় কথা সব জিনিসের একটা সংজ্ঞা থাকা দরকার। যেমন দারিদ্র্যের, অতিদারিদ্র্যের সংজ্ঞা আছে। যেমন এখন হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে। সব ক্ষেত্রে তা দরকার যাতে দেশে কোথায় কী ঘটছে তা আমরা জানতে পারি। আমরা প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের বরাদ্দ বাড়িয়ে যাচ্ছি। অথচ দেখা গেল যারা তা পাওয়ার কথা তারা তা পাচ্ছে না। এতে সরকারের সদিচ্ছা প্রতিপালনে বিঘ্ন ঘটছে। আবার খরচের গুণগত দিক অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের উপকারভোগীদের জন্য ‘ডাটাবেজ’ থাকা দরকার। থাকলে তা আপডেট করা দরকার নিয়মিত। আবার সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ের কারণে যেন অহেতুক কর্মহীন লোকের সৃষ্টি না হয় যারা মাসিক ৫০০ টাকার জন্য কাজ ফেলে মেম্বার, চেয়ারম্যানের পেছনে ঘুর ঘুর করবে।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক