বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস

দেশের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এখনো বেশকিছু জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

আজ বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ২০২৫ পালিত হচ্ছে ‘‌‍‍‍‍Malaria Ends With Us: Reinvest, Reimagine, Reignite’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে। এ প্রতিপাদ্য ম্যালেরিয়া নির্মূলে পুনর্বিনিয়োগ, নতুন চিন্তাভাবনা ও প্রচেষ্টাকে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, গত বছর বিশ্বে প্রায় ২৬৩ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ছয় লাখ প্রাণ হারিয়েছে, যাদের বেশির ভাগই আফ্রিকা ও এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর শিশু এবং গর্ভবতী নারী। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চল ও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় এটি এখনো একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসে আমাদের সবার সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ম্যালেরিয়ার ইতিহাস মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বিজ্ঞানীরা ৩০ মিলিয়ন বছর পুরনো মশার ফসিলে ম্যালেরিয়া পরজীবীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। প্রাচীন মিসরের মমি পরীক্ষায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ) ম্যালেরিয়া পরজীবীর ডিএনএ শনাক্ত হয়েছে। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস প্রথম ম্যালেরিয়ার লক্ষণ বর্ণনা করেন। মধ্যযুগ থেকে ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছে। রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোয় ম্যালেরিয়ার ভয়াবহ প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৮৮০ সালে চার্লস ল্যাভেরান প্লাজমোডিয়াম পরজীবী শনাক্ত করেন এবং ১৮৯৭ সালে রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায়। বিংশ শতাব্দীতে ক্লোরোকুইন ও ডিডিটির আবিষ্কার ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বিপ্লব ঘটালেও একবিংশ শতাব্দীতেও এটি একটি বড় হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। এ দীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করে যে ম্যালেরিয়া মোকাবেলায় আমাদের প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের ইতিহাসে উত্থান-পতনের একটি দীর্ঘ অধ্যায় রয়েছে। পাকিস্তান আমলে ডিডিটির ব্যবহারে সাফল্য এলেও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এর নিষিদ্ধকরণ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। ১৯৯০ সালে সরকার ম্যালেরিয়াকে জাতীয় জনস্বাস্থ্য সমস্যা ঘোষণা করার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। ২০০৮ সালে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৫৪ জন মৃত্যুর ঘটনা থেকে ২০২৪ সালে এসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৯ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ছয়জনে নেমে আসে। এ অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত প্রচেষ্টা। বিনামূল্যে লং লাস্টিং ইনসেক্টিসাইড নেট বিতরণ, দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের জন্য মাইক্রোস্কোপি ও র‍্যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট (আরডিটি), আর্টেমিসিনিন-ভিত্তিক থেরাপি (এসিটি) এবং কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এ সাফল্যের মূল স্তম্ভ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল ফান্ড ও ব্র্যাকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবদানও এ অর্জনে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছে। তবে এ সাফল্য ধরে রাখতে আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে।

তবে বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এখনো বেশকিছু জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজার জেলার দুর্গম অঞ্চলগুলোয় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ম্যালেরিয়ার প্রবেশ একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন ও তাপমাত্রার পরিবর্তন মশার প্রজনন বৃদ্ধি এবং নতুন প্রজাতির আবির্ভাব ঘটাচ্ছে, যা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণকে আরো জটিল করে তুলছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার উপস্থিতি, বিশেষ করে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের কিছু স্ট্রেনে। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতার অভাব ম্যালেরিয়া নির্মূলে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আমাদের আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে এখনই কিছু কৌশলগত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, মশা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মশা এবং বায়ো-লার্ভিসাইড প্রয়োগের মাধ্যমে মশার প্রজনন স্থলগুলো ধ্বংস করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত RTS,S/AS01 ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন দ্রুততম সময়ে চালু করতে হবে, বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর শিশুদের জন্য। তৃতীয়ত, ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়া নিয়ে ব্যাপক গবেষণা পরিচালনা এবং নতুন কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। চতুর্থত, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে, বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়ে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব জোরদার করে একটি সমন্বিত ও টেকসই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

ম্যালেরিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য রোগ। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এখনই এ প্রচেষ্টা শিথিল করার সময় নয়। সরকার, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি ম্যালেরিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ২০২৫-এ আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক"মশার কামড়ে কেউ যেন প্রাণ না হারায়, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলি ম্যালেরিয়ামুক্ত বাংলাদেশ।"এ লক্ষ্য অর্জন শুধু স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আসুন সবাই মিলে একটা ম্যালেরিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে কোনো শিশু মশার কামড়ে মৃত্যুবরণ করবে না, কোনো মা তার সন্তানকে ম্যালেরিয়ায় হারাবে না। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে।

ড. কবিরুল বাশার: কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও