সুস্থ মাটির গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার পক্ষে সমর্থন করার উপায় হিসেবে প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করা হয়। দিবসটি মাটির জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে এবং মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি, ক্ষয় ও দূষণ হ্রাস, জল পরিস্রাবণ এবং সঞ্চয় বৃদ্ধি, টেকসই কৃষিখাদ্য ব্যবস্থা অর্জন এবং কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশনে অবদান রাখতে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
- এ বছর আমরা ‘মাটির যত্ন: পরিমাপ, মনিটর, ব্যবস্থাপনা’ থিম নিয়ে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উদযাপন করছি, যা জীবন, জীবিকা এবং প্রকৃতি বজায় রাখার জন্য মাটির সম্পদ বোঝা, ওকালতি করতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং টেকসইভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য মাটির তথ্য ও তথ্যের গুরুত্বকে তুলে ধরে। আমাদের খাদ্যের ৯৫ শতাংশেরও বেশি মাটি থেকে উদ্ভূত হয়। মৃত্তিকাসম্পদের স্বাস্থ্য সরাসরি মানবতা এবং গ্রহের বেঁচে থাকার সঙ্গে জড়িত। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে পৃথিবীতে মানুষসহ সব জীবের দেহ বিশ্লেষণ করলে যেসব মৌলিক উপাদান এবং জৈব যৌগ (জেনেটিক কোডসহ) পাওয়া যায়, তার সবগুলোই মৃত্তিকায় বিদ্যমান।
- মাটি তার ভৌত বৈশিষ্ট্যের তুলনায় একটি বহুমুখী ভূমিকা পালন করে। এটি একটি গতিশীল আবাস, যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অন্যান্য অণুজীব, পোকামাকড় এবং বৃহত্তর স্তন্যপায়ীদের মতো বহু প্রজাতির প্রাণিজগৎকে ধারণ করে। এ সম্পদশালী জীববৈচিত্র্য পুষ্টির চক্র, পানি চক্র এবং পোকা নিয়ন্ত্রণের মতো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবান মাটি আমাদের ইকোসিস্টেমকে উদ্দীপিত করে, কৃষি উৎপাদনশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং খাদ্য ব্যবস্থার স্থায়িত্বে অবদান রাখে। কিন্তু আমরা উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ করছি যে মাটির ক্ষয়, দূষণ এবং অবনতি আমাদের সেই অত্যাবশ্যক সম্পদকে সংকুচিত করছে।
- মাটির স্বাস্থ্য তিনটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। প্রথমত, লক্ষ্যমাত্রা ২: ক্ষুধা নির্মূলের জন্য ৯৫ শতাংশ খাবার মাটির ওপর উৎপাদিত হয়, তাই স্বাস্থ্যকর মাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্যমাত্রা ৩: স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবারের বৃহত্তর উৎপাদনের জন্য স্বাস্থ্যকর মাটি অপরিহার্য। তৃতীয়ত, লক্ষ্যমাত্রা ১৩: জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায়, সঠিক মাটি ব্যবস্থাপনা আমাদের ইনপুট কমাতে, পুষ্টির লিকেজ এবং রানআউট কমাতে এবং কার্বন শোষণ উন্নীত করতে সাহায্য করে। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা ১৫: ২০৩০ সালের মধ্যে ভূমি অবক্ষয় নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য, জীবনধারণের জন্য ভূমি রক্ষা করা জরুরি। এ সবকিছু মিলিয়ে মাটির স্বাস্থ্য আমাদের উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যক।
- মাটির স্বাস্থ্য হলো টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা এবং সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি। আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে যে স্বাস্থ্যকর মাটির একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে, যা পুষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই জীবিকার জন্য অপরিহার্য। মাটির যত্ন নিতে এবং এটি রক্ষা করতে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি জরুরি। স্বাস্থ্যকর মাটি কেবল কৃষির জন্য নয়, বরং মানবজীবন, পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার জন্যও অপরিহার্য। বিশ্বব্যাপী মাটির পরিচর্যা নিশ্চিত করতে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক দিক থেকে একটি ন্যূনতম সূচক সেট স্থাপন করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ ভৌত সূচকগুলোর মধ্যে মাটির আর্দ্রতা, ঘনত্ব ও গঠন অন্তর্ভুক্ত হতে পারে; রাসায়নিক সূচকগুলোর মধ্যে পিএইচ, পুষ্টি উপাদানগুলোর ঘনত্ব ও বিষাক্ততা পরিমাপ করা যেতে পারে এবং জৈবিক সূচকগুলোর মধ্যে মাটির প্রাণবৈচিত্র্য এবং জৈব পদার্থের স্তর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য, এসব সূচকের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পর্যবেক্ষণের সময়রেখা রাখতে হবে, যাতে আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করতে পারি। দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার পাশাপাশি, তথ্য পরিচালনার জন্য একটি কার্যকর সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মাঠ, দূরবর্তী বা ল্যাবরেটরিতে হতে পারে, যা সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে।
- মাটির মাইক্রোবায়োম (অণুজীব সমগ্র) পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যময় মাইক্রোবায়াল ইকোসিস্টেম, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, আর্কিয়া, ভাইরাস ও প্রোটিস্ট বিদ্যমান। এই মাইক্রোবায়াল সম্প্রদায়গুলো গাছের স্বাস্থ্য এবং তাদের বিভিন্ন অভিঘাতের (যেমন খরা, ভারী ধাতু দূষণ ও প্যারাসাইটস) বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটি ও এর মাইক্রোবায়োম মানুষের খাদ্যের ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত সরবরাহ করে। কিন্তু খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পূর্বাভাস দিয়েছে, মানব কার্যকলাপ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটির অবক্ষয় কৃষিখাদ্য ফলনের ২০-৮০ শতাংশ ক্ষতির কারণ হতে পারে। এর ফলে নতুন টপসয়েল তৈরি হওয়ার হার অত্যন্ত ধীর, যা সাধারণত বছরে মাত্র দশমিক ২৫ থেকে ১ দশমিক ৫ মিমি।
- ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯৮০ কোটিতে পৌঁছার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, নতুন সমাধানের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। এ সমাধানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাটির অণুজীবের কার্যকর ব্যবহার। বিশেষ কিছু মাটির মাইক্রোবায়োম সম্পৃক্ত উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাড়াতে সার অথবা কীটনাশক হিসেবে কাজ করতে পারে, ফলে কেমিক্যাল ব্যবহারের ওপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হয়। এছাড়া এ অণুজীবগুলো লবণাক্ত অথবা ক্ষারীয় মাটিতে উদ্ভিদের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। মাটির অণুজীব জৈব এবং ভারী ধাতু দূষিত পদার্থের পরিশোধনে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের মাধ্যমে কার্বন চক্র এবং সিকোয়েস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা হয়, সেই সঙ্গে পরিবেশে কার্বন ধারণ এবং সঞ্চয়ের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। বর্তমানে আমাদের পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের মতো মানবসৃষ্ট সমস্যার সম্মুখীন, যা মাটির ইকোসিস্টেম এবং তাদের উপকারী সেবাগুলোর ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় অঞ্চলে সাগরের স্তরের উত্থান, লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটির বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা এবং শুষ্কতায় প্রভাব ফেলছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য মাটির অণুজীব নিয়ে নতুন করে গবেষণা ও তাদের ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি।
- তবে এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে মাটির গুণাগুণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ইউনেস্কো (২০২৪) জানিয়েছে, বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ মাটির গুণাগুণ অবক্ষয় হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করবে। যখন ভূমি অবক্ষয় হয়, তখন এটি খাদ্য সুরক্ষা, জলের প্রাপ্যতা এবং বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, সরাসরি অর্ধেক মানবতাকে প্রভাবিত করে এবং প্রতি বছর প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বাস্তুসংস্থান পরিষেবাগুলো হ্রাস করে, যা ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় অর্ধেক ৯৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছিল। ভূমি অবক্ষয়কে স্থলজ জীববৈচিত্র্য হ্রাসের একক বৃহত্তম কারণ হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনে যথেষ্ট অবদান রাখে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবক্ষয়প্রাপ্ত জমি থেকে বার্ষিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড।
- মাটির স্বাস্থ্য বিভিন্ন পরিবেশ এবং স্থানীয় ফ্লোরা ও ফনার ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। তবে মাটির প্রাণিকুল সাধারণত সেই ওপরের স্তরে ঘটে, যেখানে জৈব পদার্থ ও খনিজ উপাদানগুলোর ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। মৃত উদ্ভিদ, যেমন পাতা, এ স্তরকে পুষ্ট করে এবং গভীর ইকোসিস্টেমের জন্য কার্বন সরবরাহ করে। মাটি প্রধানত ভূমির ইকোসিস্টেমে কার্বনের একটি বৃহৎ অংশ সঞ্চয় করে (প্রায় ৮০ শতাংশ)। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে আর্কটিক অঞ্চলে মাটির তাপমাত্রা বাড়লে মাইক্রোবগুলোর কার্যকলাপ বেড়ে যায়, যা প্রাচীন মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে কার্বন মুক্ত করে। ফলে পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে কার্বনের স্থিতিশীলতা হ্রাস পেতে পারে। কিছু মডেল আশঙ্কা করে যে পরিবেশগতভাবে উচ্চতর কার্বন প্রথমে উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু এটি মাটির অণুজীবের বৈচিত্র্যকে হ্রাস করবে, যা পরে উদ্ভিদের গুণমান হ্রাস করবে। পাশাপাশি অণুজীব অনেক জাতীয় গাছের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এবং জলবায়ু পরিবর্তন কিছু অঞ্চলে গাছের বৈচিত্র্য ও মাটির কার্বন ধারণক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।
- কৃষিজ সব খাদ্য উৎপাদনের জন্য মৃত্তিকা একটি মৌলিক প্রাকৃতিক সম্পদ। মৃত্তিকার স্বাস্থ্যের সঙ্গে পৃথিবীর সব জীবের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। সেজন্য টেকসই কৃষিজ খাদ্যোৎপাদনের জন্য মৃত্তিকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু অর্ধশতাব্দী ধরে আমরা মৃত্তিকাসম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে কেবল বেশি ফলন বা উৎপাদনকেই ফোকাস করেছি। অধিক ফলনের লক্ষ্যে ক্রমবর্ধমান হারে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে আসছি। এসব সিনথেটিক রাসায়নিক পদার্থ নিবিড় শস্য চাষে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের মৃত্তিকার স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়। মৃত্তিকায় জৈব পদার্থ ও কার্বনের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। ফলে বর্ধিত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারেও বর্তমানে ফসলের ফলন আগের মতো বাড়ছে না। যদিও মৃত্তিকাসম্পদ ইনস্টিটিউট গত পাঁচ দশকে মৃত্তিকার ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যাবলির ডাটা তৈরি এবং কৃষককে সার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আসছে, কিন্তু মৃত্তিকার স্বাস্থ্য সম্পর্কে এসব তথ্যাবলি অসম্পূর্ণ। কারণ মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের সবচেয়ে মৌলিক অংশ হচ্ছে মৃত্তিকায় বসবাসকারী বৈচিত্র্যময় অণুজীব।
- মৃত্তিকা অণুজীব উদ্ভিদের পুষ্টি, বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও জলবায়ুর সব অভিঘাত অভিযোজনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। মৃত্তিকা অণুজীবের কার্যক্রম জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ুর পরিবর্তনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে থাকে। সেজন্য অবক্ষয়প্রাপ্ত মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা মৃত্তিকাসম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি।
- অধুনা শটগান মেটাজিনোমিকস বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা মাইক্রোবায়োমসহ মৃত্তিকা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারি। আমরা বাংলাদেশ মৃত্তিকা মাইক্রোবায়োম মানচিত্র তৈরি করে মৃত্তিকার যথাযথ ব্যবহারের ভিত্তি তৈরি করতে পারি। অবক্ষয়প্রাপ্ত মৃত্তিকা স্বাস্থ্য উন্নয়নে আমরা মাইক্রোবায়োম ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি। গতানুগতিক মৃত্তিকা পরীক্ষা এবং ব্যবহার ব্যবস্থার আশু সংস্কারের মাধ্যমে টেকসই মৃত্তিকাসম্পদের ব্যবহারে টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়াস প্রয়োজন। এছাড়া মৃত্তিকা মাইক্রোবায়োম ম্যাপের ওপর ভিত্তি করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্থানিক সমস্যা সমাধান, শস্য পর্যায় ও শস্যবিন্যাসে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। কৃষি কর্মকাণ্ড যেমন ধান চাষ, গবাদিপশুর বাণিজ্যিক খামারীকরণে মিথেনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাস উদ্গিরণ কমানোর মাধ্যমে গ্লোবাল ও স্থানিক উষ্ণায়ণ হ্রাস করে মৃত্তিকায় কার্বন সংযোজন বাড়াতে পারি। সেজন্য দেশের মৃত্তিকার হটস্পটভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন।
- গত দুই দশকে জিনোমিকস ও মেটাজিনোমিকস প্রযুক্তি দ্রুত বিকাশলাভ করেছে। এর আগে মৃত্তিকা ও পরিবেশে বিদ্যমান অণুজীবের কেবল ১ শতাংশ গবেষণারে কৃত্রিম মিডিয়ায় চাষ করে কেবল চাষযোগ্য মৃত্তিকা অণুজীবের অধ্যয়ন করা হয়েছে। ফলে প্রায় ৯৯ শতাংশ মৃত্তিকা বা পরিবেশের অণুজীবই অধ্যয়ন করা যায়নি। বর্তমান মেটাজিনোমিকস পদ্ধতিতে যেহেতু আবাদমাধ্যমে জন্মানোর প্রয়োজন নেই, ডিএনএ এক্সট্রাক্ট করে শতভাগ অণুজীবের ডিএনএ সিকোয়েন্স করে বায়োইনফরমেটিকস এবং কম্পিউটেশনাল বায়োলজির মাধ্যমে এদের প্রতিটির জীবনরহস্য উন্মোচন, একে অন্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ও পরিবেশে উদ্ভিদের কার্যাবলি বিশদ জানা যাচ্ছে। অজানা বিশাল এ প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে বিদ্যমান এনজাইম, উপকারী জৈবযৌগ, জিন ইত্যাদি উদ্ঘাটন এবং জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে তা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন এবং এদের শিল্প ও কৃষিতে ব্যবহার এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এক গ্রাম স্বাস্থ্যকর কৃষি মাটিতে ১০ বিলিয়ন পর্যন্ত অণুজীব থাকতে পারে, যা হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে। মাটিতে বিদ্যমান সর্বাধিক অণুজীব হল ব্যাকটেরিয়া, তবে আর্কিয়া, প্রোটিস্ট, ছত্রাক, ভাইরাস ও অন্যান্য আণুবীক্ষণিক জীবও রয়েছে।
- মাটির অণুজীব সম্প্রদায়ের গঠন প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রের জন্য অনন্য। মাটিতে যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া জন্মে তা মাটির সামগ্রিক গঠন দ্বারা নির্ধারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ উদ্ভিদের শিকড়ের চারপাশের অঞ্চল, যা রাইজোস্ফিয়ার নামে পরিচিত, প্রতি গ্রাম মাটিতে ১০ বিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া কোষ থাকতে পারে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদকে আহরণ এবং তা কৃষি ও শিল্পে ব্যবহারের জন্য চাই প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও জ্ঞান। সুতরাং মৃত্তিকাবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে জিনোমিকস, বায়োইনফরমেটিকসসহ অন্যান্য উদীয়মান বিষয় সংযুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া গবেষণা প্রকল্পে জীবপ্রযুক্তিবিদ, ডাটা সায়েন্টিস্টসহ সম্পর্কিত বিষয়াবলির বিশেষজ্ঞ সংযোজন করা প্রয়োজন। মৃত্তিকা অণুজীব স্ট্রেপটোমাইসিস থেকে প্রায় চার শতাধিক মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রাণরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করে জাপানিজ বিজ্ঞানী সাতেশি ওমুরা ২০১৫ সালে শারীরবিদ্যা অথবা চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি মৃত্তিকা অণুজীব থেকে শুধু প্রাকৃতিক মূল্যবান যৌগ আবিষ্কার করে এদের ব্যবহার ও অণুজীবে এদের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোও উদ্ঘাটন করেছিলেন। সুতরাং বিজ্ঞানের এ যুগে মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ ব্যতিরেকে কোনো ব্রেকথ্রো করা সম্ভব নয়।
- বাংলাদেশের মৃত্তিকার যথেচ্ছ ব্যবহার, শিল্প বর্জ্যের বিশোধন ব্যতিরেকে পরিবেশে নিঃসরণ, যথেচ্ছ পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং তা পরিবেশে ফেলে দেয়া, নিম্ন মানের রাসায়নিক ও বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত ভূগর্ভস্থ সেচ পানির উত্তোলনের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকার মৃত্তিকা ও জলাভূমি আজ ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, ক্রোমিয়ামে দূষণ এবং মাইক্রো-, ন্যানো ও প্লাস্টিক নিঃসরিত মানুষ ও অন্যান্য জীবের হরমোনাল সিস্টেম ধ্বংসকারী রাসায়নিক (প্লাস্টিসাইজার যেমন বিসফেনল এ ইত্যাদি) মানবকুলসহ সব জীবের স্বাস্থ্য, প্রজননে এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁডিয়েছে। মৃত্তিকারও উৎপাদিকা শক্তিকে হ্রাস করছে। গবেষণার মাধ্যমে তা নিরুপণ করে এবং কার্যকরী আইন ও নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। জাপানের ন্যায় কৃষি উৎপাদনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জৈবসার এবং জৈব বিকল্প ব্যবহারের বাধ্যবাদকতা আনয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। এসব জৈব উপকরণ উৎপাদনের ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
- বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি বর্তমানে ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যেখানে আদর্শভাবে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থের উপস্থিতি মাটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ন্যূনতম মাত্রা ২ শতাংশ হওয়া আবশ্যক। মাটি নিজস্ব সার পুনর্ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখলেও শিল্পবর্জ্য পুনর্ব্যবহার সম্ভব নয়। এর ফলে শিল্প দূষণের প্রভাবে মাটির উপরিভাগ দিন দিন প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। ইটভাটাগুলোও একটি বড় দূষণের উৎস, যা সরাসরি মাটির অবক্ষয় ঘটায়। মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ পরস্পরকে প্রভাবিত করে এবং এভাবেই একটি দূষিত চক্র তৈরি হয়। দূষিত বায়ু ও পানি অবশেষে মাটিতে জমিয়ে তৈরি করে নতুন সমস্যা। এ ধরনের পরিবেশগত ক্ষতি শুধু কৃষির জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং অন্যান্য উদ্ভিদ ও মাইক্রোবায়াল জীবজগৎকেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে প্লাস্টিক মাটি দূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
- বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মাটি ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণবৈচিত্র্য টিকে থাকতে পারে না। এটি শুধু আমাদের খাদ্য সরবরাহ করে না, বরং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড. তোফাজ্জল ইসলাম: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি