দুই বছরে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লক্ষ্য বেজার

অবকাঠামোগত ও জন-উপযোগ সেবা নিশ্চিত করা ব্যতীত লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়ানো।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়ানো। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর এক ‍যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বেজার অধীনে থাকা অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে পারেনি। বরং বিদেশী বিনিয়োগের স্থিতি কমেছে, যা জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’-এ উঠে এসেছে। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ এলেও বছর শেষে মোট বিদেশী বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ বা স্থিতি কমে গেছে। এ বছর শেষে বিদেশী বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। আগের বছর তথা ২০২২ সালে যা ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার।

এদিকে গত বছরের শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এফডিআইয়ের হিসাব তুলে ধরলে একই চিত্র দেখা যায়। মুনাফা প্রত্যাবাসনে ভোগান্তি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতাসহ অন্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আগের অর্থবছরের তুলনায় এফডিআই প্রবাহ ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে।

বিনিয়োগ কমার কারণ হিসেবে বিনিয়োগকারীরা হরহামেশাই পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সমস্যাসহ জন-উপযোগ সেবা (পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস) নিশ্চিত করতে না পারাকে দায়ী করেছেন। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং উপযুক্ত সড়ক অবকাঠামো নেই। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সংকট ও অস্থিতিশীলতার কারণে বর্তমানে সেবার মান আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে নীতি ধারাবাহিকতার প্রশ্নটিও উদ্বেগ তৈরি করেছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।

এ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বেজার আগামী দুই বছরে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও আড়াই লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রত্যাশা কতটা পূরণযোগ্য তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেজার অধীনে মাত্র ১৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ বা উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত এসব অঞ্চলে বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে দেড় বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছর পর্যন্ত জোনগুলোয় প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ৭৬ লাখ ডলারের।

বেজা প্রকৃত প্রস্তাবে দেশী-বিদেশী সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রত্যাশা পূরণ করতে চাইলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাঠামোগত ও জন-উপযোগ সেবা সমস্যার সমাধান করতে হবে। বেজার তথ্য অনুযায়ী, সরকার এখন পর্যন্ত ৯৭টি জোনের অনুমোদন দিয়েছে, যদিও এর মধ্যে পুরোপুরি চালু হওয়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) সংখ্যা খুবই কম। প্রস্তাবিত অঞ্চলগুলোর বেশির ভাগই সম্ভাব্যতা যাচাই, জমি অধিগ্রহণ ও অঞ্চলভিত্তিক সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব চিহ্নিত করার পর্যায়ে রয়েছে। অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে জমিস্বল্পতা ও জটিল জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে সফল ও কার্যকর হিসেবে প্রতীয়মান করতে হবে। তাহলে এসব অঞ্চলকে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে বিনিয়োগ গন্তব্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তুলে ধরা সম্ভব হতো। এছাড়া ট্যাক্স সুবিধা, ফিসক্যাল পলিসি, পরিষেবা মূল্য ও পানিসংক্রান্ত নীতির প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোপুরি প্রস্তুত করে এ নিয়ে যথাযথভাবে প্রচার ও বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করলে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আসবে—এ প্রত্যাশা করা যায়। অন্যদিকে সব জোনেরই বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অবকাঠামো। রিলায়েবল পাওয়ার, গ্যাস ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না। যতগুলো জোন করা হচ্ছে তার অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। অনেকগুলোয়ই জমিসংক্রান্ত ঝামেলা রয়েছে। এজন্য সরকারি প্রক্রিয়ায় ইকোনমিক জোনকে ভিন্নমাত্রায় দেখা প্রয়োজন। বিনিয়োগের পরিবেশ যেন বহাল থাকে সেটি খেয়াল রাখতে হবে।

সম্প্রতি বিগত সরকারের নেয়া ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে বেজা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগামী দুই বছরে সংস্থাটি পাঁচ সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে কাজ করা হবে বলে জানিয়েছে। প্রত্যাশা রয়েছে, এ পাঁচ অঞ্চলে সব ধরনের অবকাঠামো ও পরিষেবা সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। বিশেষ করে গ্যাস সংকট সমাধানে নজর দিতে হবে। এরই মধ্যে গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদনহীন অবস্থায় রয়েছে।

তবে এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর দিকেও বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন। বেজার তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৩টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদিত হয়েছে, যার মধ্যে আটটিতে কার্যক্রম রয়েছে এবং সেখানে কারখানাগুলোয় উৎপাদন হচ্ছে। তবে অনেক কারখানা গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না, যদিও এরই মধ্যে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সম্প্রতি বেজার ঘোষণা দেয়া পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে চারটি সরকার পরিচালিত এবং একটি সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। বেজা এগুলোয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জন-উপযোগ সেবা নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় এ সেবা নিশ্চিত করা না গেলে বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়বে বলে প্রতীয়মান হয় না। কারণ দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের আকারই বড়। শিগগিরই বেজার পক্ষ থেকে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জন্যও একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হোক, যা তাদের জ্বালানি সংকট ও পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দেবে।

আরও