বাংলাদেশ এক সময় বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত পাট ও পাটের তৈরি রফতানির মাধ্যমে। পাটকলে লাখ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত ছিলেন। এখন বেশির ভাগ পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এ খাত থেকে রফতানি আয় তেমন আসে না। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ এখন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাউস। সামনের দিনে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বে পোশাক রফতানির বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে। এর মূল কারণ হলো বাংলাদেশে শ্রম আইন আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়। মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে বারবার সমালোচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, শ্রমিক অধিকার, শিশুশ্রম, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে বহুল সমালোচিত। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের ওপর কর্মরত শ্রমিক নানাভাবে মালিক ও সরকারের মাধ্যমে হেনস্থা হচ্ছেন। শ্রমিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে কোনো সুসম্পর্ক নেই। যে কারণে কিছু দিন পর পর পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। শ্রমিক আন্দোলনের মুখে মালিক পক্ষ শক্ত অবস্থান নেয়। শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে অনড় থাকেন। দুঃখজনক যে পোশাক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা অর্থনীতির চাকা ঘোরানো সত্ত্বেও সরকার মালিকদের পক্ষ নেয়। রফতানি খাতে প্রণোদনা দেয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে সরকার। পোশাক শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার নীতি প্রণয়ন করতে কখনো দেরি করে না। কিন্তু এ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা সরকারের দেয়া শ্রমসংক্রান্ত নীতির ওপর সন্তুষ্ট হন না। এর ফলে চলমান অস্থিরতা দেখা যায়। এর প্রভাব পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। ক্রেতারা সঠিক সময়ে পণ্য পান না, শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে দেন, বেকারত্ব বেড়ে যায়। শ্রমিকদের আয় বন্ধ হওয়ার কারণে তারা জীবনমান ধরে রাখতে পারেন না। সর্বশেষ রফতানি আয়ের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। রিজার্ভ সংকট বাড়তে থাকে।
কিছু দিন আগে পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য বার্ষিক ৯ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। শ্রমিকরা চেয়েছিলেন ১৫ শতাংশ। এ সিদ্ধান্ত ঘিরে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েই চলছে। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির ভেতর ৯ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি শ্রমিকদের জীবনমান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ে মজুরি হার সে হারে বাড়ে না। এ বছরের জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। তখন মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। পরে নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশের বিপরীতে মজুরি হার বাড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলা যায় যে শ্রমিকদের চাওয়া ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা অযৌক্তিক ছিল না। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির ভেতর ৯ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বাড়িয়ে শ্রমিকদের জীবনমান ধরে রাখা কি সম্ভব? মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। শ্রমিকরা এখন সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রোগাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির ওপর। কিছুদিন আগে অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান বলেন, শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতে শ্রমশক্তির কম উৎপাদন সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২৪-২৫ এর প্রতিবেদন বলেছে, স্বল্প মজুরির শ্রমিকের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরি ১০৫ ডলার (এখন কিছুটা বাড়ছে), ভিয়েতনাম ১৩২-১৯২, শ্রীলংকা ১২৫, জর্ডান ৩৬৬, হাইতি ১৫৯ ও ইন্দোনেশিয়ায় ২৫৮-৩২০ ডলার। বাংলাদেশ ৪৫ বছর ধরে সস্তা শ্রম দিয়ে পোশাক খাতে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সস্তা শ্রম দিয়ে প্রতিযোগিতা বাজারে টিকে থাকা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সস্তা শ্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বৈশ্বিক মানের সঙ্গে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে আসছে সব সময়। এ বছরের নভেম্বরে মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল এসেছিল শ্রমসংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনার জন্য। মার্কিন প্রতিনিধি বলেছে, সস্তা শ্রমে আটকে থাকলে পণ্যের মূল্য বাড়বে না। বিশ্বে উন্নততর ব্র্যান্ড কখনো সস্তা শ্রম কেনে না। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের মজুরি সন্তোষজনক হারে বাড়লে মার্কিন ক্রেতারা দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়াদেশের প্রতিশ্রুতি দেবে। উল্লেখ্য কম্বোডিয়ায় কারখানার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তি অনুযায়ী, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ালে মার্কিন ক্রেতারা দীর্ঘমেয়াদে ক্রয়াদেশের মাধ্যমে অগ্রিম বুকিং নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশে শ্রম অধিকারসংক্রান্ত ১১ দফা বাস্তবায়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর অংশ হিসেবে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজ করতে হবে। এছাড়া ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমমান নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন করতে কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন থাকার নিয়ম রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থার জন্য এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ শ্রম অধিকারচর্চার দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা। সেখানে আরো বলা হয়েছে, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ও জেন্ডার সমতার জন্য অপরিহার্য।
শ্রমসংক্রান্ত সমস্যার কারণে বাণিজ্যিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশ ইইউ থেকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) পাবে না। তখন উচ্চ শুল্ক দিয়ে পণ্য প্রবেশ করাতে হবে। আবার শ্রম অধিকার নিশ্চিত না হলে ইইউ থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া যাবে না। ইইউ থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে ৩২টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন পরিপালন করতে হবে। এছাড়া শ্রম খাতের ওপর নেয়া জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের মোট রফতানির ৫৮ শতাংশ করা হয় ইইউ দেশগুলোয়। জিএসপি বন্ধ হয়ে গেলে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে। রফতানি আয় কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রফতানি করতে হয়। র্যাপিড গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বলেছে, ইইউ-বহির্ভূত দেশগুলো থেকে ইইউ যত পোশাক আমদানি করে তার ২১ দশমিক ৭ শতাংশ আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে। পোশাক রফতানির জন্য ইইউ বাজার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বলা প্রয়োজন যে রানা প্লাজা ধস এবং তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দেয়। তবে বাংলাদেশ যদি শ্রম আইন, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার বিষয়ে অগ্রসর হতে পারে তাহলে ইইউ থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ভালো সংবাদ যে ২০২৩ সালে ইইউ থেকে দেয়া ‘ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিও’ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এটা বাস্তবায়ন জরুরি। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক খাতে সংস্কারকাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। এ কমিশন গঠন করার ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা শ্রম আইনকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সমমান পর্যায়ে নিতে চায়। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। পোশাক রফতানি বাজারগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যদি সমকক্ষ দেশের সঙ্গে টিকে থাকতে চায়, তাহলে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পোশাক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের জীবনমান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক মানের শ্রম আইন জরুরি।
মো. মাজেদুল হক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি এক্সচেঞ্জ