আমার
বিদেশে কর্মরত
বন্ধু ও
অনুজপ্রতিমরা প্রায়ই
যে প্রশ্নটি
ছুড়ে দেন,
তা হলো—বাংলাদেশে
সরকারের উচ্চপদে
নিয়োগের যোগ্যতা
কী? মন্ত্রীপদে
নিয়োগের যোগ্যতা
নিয়েও সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে এমনকি
করোনাকালেও দেখছি
অনেকেই সরব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনায় যখন এক গভর্নর চাকরিতে ইস্তফা দেন, তখন দেশের পত্রপত্রিকাগুলোকে গভর্নর পদে নিয়োগের যোগ্যতা নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তুলতে দেখেছি। সর্বশেষ গভর্নরের বয়সসীমা বাড়ানো নিয়ে প্রশ্নটি আবার সামনে এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, দু-একটি পত্রিকা তার স্ত্রীর শুধু একদিনের জন্য সচিব পদে পদোন্নতি এমনকি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন বা সরকারের কী পদে তিনি প্রথম যোগদান করেছিলেন—এ বিষয়গুলোও দু:খজনক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে এনেছে। তার কাজের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে এমন সমালোচনা মোটেই কাম্য নয়।
এক্ষেত্রে একটি
উল্লেখ্য প্রতিবেদনের
ভালো দিক
হলো, এতে
গভর্নর পদের
প্রয়োজনীয় যোগ্যতা
নিয়ে বিশদ
বলা হয়েছে।
প্রতিবেদক বা
যারা পেছন
থেকে তাকে
সহায়তা করেছেন
বা ‘সোর্স’
হিসেবে ব্যবহূত
হয়েছেন, তাদের
মতে ‘দেশের
মুদ্রা সরবরাহ
কত হবে,
টাকার মান
কতটা বাড়বে
বা কমবে,
মূল্যস্ফীতির হার
কত রাখা
ঠিক হবে—এসবই
ঠিক করেন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
গভর্নর। পাশাপাশি
দেশের মানুষের
জীবনযাপনের মান,
অভ্যন্তরীণ ও
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য,
বিনিয়োগ ও
কর্মসংস্থানের বিষয়
সম্পর্কেও গভর্নরকে
খোঁজ রাখতে
হয়।’ তাদের
মতে, ‘এ
পদে কে
থাকবেন, সেই
সিদ্ধান্ত নেয়ার
আগে সব
দেশের সরকারই
তাই বারবার
চিন্তা করে।’
প্রতিবেদক আরো
যোগ করেছেন,
‘এত গুরুত্বপূর্ণ
পদ হওয়া
সত্ত্বেও কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের গভর্নর
নিয়োগের কোনো
নীতিমালা নেই
বাংলাদেশে। ফলে
তার যোগ্যতার
কথাও বলা
নেই কোথাও।
এ সুযোগ
নিয়েই যে
কাউকে গভর্নর
বানায় সরকার।’
তিনি আরো
বলেছেন, ‘অনেক
দেশ গভর্নর
বেছে নেয়
আন্তর্জাতিক অর্থ
ব্যবস্থাপনা ও
ব্যাংকিংয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন
কোনো ব্যক্তিকে।
তবে বিশেষজ্ঞরা
বলে থাকেন,
অংকশাস্ত্র, ব্যাংকিং
ও প্রশাসনিক
দক্ষতাসম্পন্ন লোকদেরই
গভর্নর পদে
বসানো উচিত।
পাশাপাশি দেখা
উচিত তার
শক্ত ব্যক্তিত্ব,
সততা, নীতিনিষ্ঠতা
ও স্বাধীনচেতা
মনোভাব আছে
কিনা।’
প্রতিবেদক উল্লেখ
করেছেন, ‘বিশিষ্ট
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন
মাহমুদের নেতৃত্বাধীন
১৯৯৬ সালে
গঠিত ব্যাংক
সংস্কার কমিটি
১৯৯৯ সালে
যে প্রতিবেদন
দাখিল করে,
তাতে বাংলাদেশ
ব্যাংকের গভর্নর,
ডেপুটি গভর্নরসহ
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের
পরিচালক ও
এমডিদের তালিকা
তৈরির জন্য
একটি জাতীয়
ব্যাংকিং উপদেষ্টা
পরিষদ গঠনের
সুপারিশ করেছিল।
গভর্নরের মেয়াদ
পাঁচ বছর
করা এবং
পদমর্যাদা সুপ্রিম
কোর্টের বিচারকের
সমান করার
সুপারিশও করা
হয়েছিল তাতে।
ওই সুপারিশ
সরকার আমলে
নেয়নি।’
আমার ধারণা
অংকশাস্ত্র বোঝাতে
প্রতিবেদক বা
বিশেষজ্ঞরা ‘হিসাবনিকাশের’
জ্ঞান বুঝিয়েছেন।
অংকশাস্ত্রের কেউ
কোথাও গভর্নর
হয়েছেন বলে
আমার অবশ্য
জানা নেই।
এটাও মনে
হয় না
যে কোনো
দেশে গভর্নর
মহোদয় নিজে
সরাসরি মুদ্রানীতি
রচনায় অংশ
নেন বা
অন্যান্য নীতিমালাও
তৈরি করেন।
তবে তার
অবশ্যই মুদ্রানীতি,
রাজস্বনীতি তথা
সামগ্রিক অর্থ
ব্যবস্থার সঙ্গে
এটির সম্পর্ক,
বাজারে মুদ্রার
সরবরাহ, বৈদেশিক
মুদ্রা বিনিময়
হার, দায়-সম্পদ
বা ব্যাংকের
স্থিতিপত্র ব্যবস্থাপনা,
বিশ্বায়নের যুগে
ঋণ, পরিচালন
ও বাজার
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা,
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
এবং আন্তঃদেশীয়
লেনদেন বিষয়ে
সম্যক ধারণা
থাকতে হবে।
প্রযুক্তির অধিক
ব্যবহারের এই
যুগে প্রযুক্তির
ব্যবহার ও
রূপান্তর, সাইবার
নিরাপত্তা এবং
বিভিন্ন জালিয়াতির
ধরন বা
রকমফের বিষয়েও
জ্ঞান থাকার
প্রয়োজনীয়তা রয়েছে
বৈকি। ভারত,
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ
দেশগুলোয় বেশির
ভাগ গভর্নর
এসেছেন সরকারি
কর্মকর্তাদের মধ্য
থেকে আর
শুধু কিছুসংখ্যক
ছিলেন অর্থনীতিবিদ।
১৯৯২ থেকে
২০১৮ সাল
পর্যন্ত বেশির
ভাগ বাংলাদেশ
ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তা এবং
অর্থ সচিবদের
কাছে আমার
কৃতজ্ঞতার শেষ
নেই, বিশেষ
করে ড.
ফখরুদ্দিন আহমদ,
ড. সালেহউদ্দিন
আহমেদ, আল্লাহ
মালিক কাজেমি,
ড. আকবর
আলি খান,
জাকির আহমেদ
খান, ড.
মোহাম্মদ তারেকসহ
আরো কিছু
পদস্থ কর্মকর্তা,
এমনকি মাননীয়
অর্থমন্ত্রীরা এবং
উপদেষ্টাদের কাছেও
আমি অনেক
ঋণী। তাদের
প্রায় প্রত্যেকেই
কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং,
সরকার ও
রাষ্ট্র নামক
বিষয়টি নিয়ে
আমাকে সম্যক
ধারণা পেতে
সহায়তা করেন।
আকবর আলি
খান এদিক
দিয়ে সবচেয়ে
এগিয়ে। ২০০১
সালের শেষ
দিকে তিনি
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক
ব্যাংকের সম্ভাব্য
প্রধান নির্বাহী
হিসেবে তত্কালীন
মুখ্য সচিব
ড. কামাল
সিদ্দিকীর কাছে
আমার নাম
প্রস্তাব করেন,
তিনি আবার
আমার সঙ্গে
কথা বলে
আমাকে তত্কালীন
শিল্প সচিব
আল-আমীন
চৌধুরীর কাছে
সোপর্দ করেন।
তবে শেষ
পর্যন্ত বিভিন্ন
দিক বিবেচনায়
আমার আর
সে পথ
মাড়ানো হয়নি।
২০০৫ সালে
বিশ্বব্যাংক থেকে
ফিরে এসে
তিনি আবার
বাংলাদেশ ব্যাংকের
ডেপুটি গভর্নর
পদের বিষয়টিতে
আমার মনোযোগ
আকর্ষণ করলেও
নিজেই আবার
এ পদে
‘কিছু করার
নেই’ বলে
আমাকে অন্য
পরামর্শ দেন।
২০০৮ সালে
মাহবুব জামিল
আমাকে অনেকটা
পটিয়ে প্রাইভেটাইজেশন
কমিশনের সম্ভাব্য
প্রধান হিসেবে
ড. ফখরুদ্দিনের
কাছে নিয়ে
যান। আমি
অনেকটা সাহস
নিয়ে ড.
ফখরুদ্দিনকে বুঝিয়েছি
‘প্রাইভেটাইজেশন কমিশনকে
বরং অবিলম্বে
বিলুপ্ত করা
উচিত।’
২০০৯ সালে
কে বা
কাদের সুপারিশে
আমার নাম
আবার সম্ভাব্য
গভর্নরের তালিকায়
উঠে আসে।
তালিকায় এক
কিংবা দুই
নম্বর ব্যক্তিদের
সামগ্রিক যোগ্যতা
আমার চেয়ে
নিঃসন্দেহে ভালো
ছিল। পরে
শুনেছি অনেক
কিছুর মাঝে
আমার অযোগ্যতা
হিসেবে বিবেচিত
হয়েছে—১.
পেশাগত জীবনে
প্রায় পুরো
সময় বিদেশী
ব্যাংকে কাজ
করেছি বলে
গরিবের দুঃখ
না বুঝতে
পারার সমূহ
সম্ভাবনা এবং
২. কোনো
রাজনৈতিক ‘নিশানা
বা মিনার’
ঠিক না
থাকা।
তার পরেও
আমি শেষ
হয়েও হইনি
শেষ। অর্থ
মন্ত্রণালয় ও
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয়ের কিছু
কর্তাব্যক্তির আলোচিত
সুনজরের কারণে
আমি কখনো
আবার হারিয়েও
যাইনি। একজন
কর্তাব্যক্তির কথা
আমার এখনো
কানে বাজছে—‘ইউ
হ্যাভ এন
ইম্প্রেসিভ সিভি।
উই উইল
ওয়ার্ক আউট
সামথিং ফর
ইউ’ (আপনার
রয়েছে একটি
আকর্ষণীয় কর্ম
অভিজ্ঞতা, আপনাকে
আমরা কাজে
লাগানোর চেষ্টা
করব)।
২০১১ সালে
আর্থিক খাতের
ওপর একটি
নিয়ন্ত্রক সংস্থার
প্রধান হিসেবে
অর্থ মন্ত্রণালয়
আবার আমার
নাম প্রস্তাব
করে। আমার
নামটি তালিকায়
শীর্ষস্থানে থাকায়
সংগত কারণেই
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা
সংস্থার একজন
পদস্থ কর্মকর্তা
এবং অন্য
একটি ক্যাডেট
কলেজের অনুজসদৃশ
জরুরি ভিত্তিতে
আমার কাছে
একটি অনেকটা
‘রেডিমেড’ প্রশ্নপত্র
পাঠান। এতক্ষণ
ইনিয়ে বিনিয়ে
যা বলতে
চেয়েছি তা
এখন আশা
করি পরিষ্কার
হয়ে যাবে।
ওই কর্মকর্তা
আমাকে ‘আর্জেন্ট
ক্লিয়ারেন্সে’র
জন্য ঝটপট
চারটি প্রশ্নের
উত্তর পাঠাতে
বলেন। যদ্দূর
মনে পড়ে,
প্রশ্নগুলো ছিল—১.
১৯৭১ সালে
আপনার কিংবা
আপনার পরিবারের
ভূমিকা কী
ছিল? ২.
ছাত্রাবস্থায় আপনি
কোনো ছাত্র
সংগঠনের সঙ্গে
সম্পৃক্ত ছিলেন
কিনা, থাকলে
সংগঠনটির নাম
কী? ৩.
২০০৭-০৮
সালে গণতন্ত্র
পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে
আপনার কোনো
ভূমিকা ছিল
কিনা? ৪.
আপনাকে আর্থিক
খাতের সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট একটি
নিয়ন্ত্রক সংস্থার
প্রধান হিসেবে
বিবেচনা করা
হচ্ছে। এ
পদে বিবেচনার
স্বপক্ষে আপনার
যোগ্যতার বিবরণ
দিন।
আমি নিশ্চিত
পাঠকদের অনেকেই
আমার উওরগুলো
আর জানতে
চান না
কিংবা বেশি
বেশি চাইলে
আরেকদিন বলব।
তবে এতে
সরকারের উচ্চপদে
নিয়োগ যোগ্যতা
বিষয়ে একটি
সম্যক ধারণা
তারা এরই
মধ্যে পেয়ে
গেছেন এবং
সেই একই
কারণে সরকার
মহাশয়ের কাছে
আমার মতো
সারা জীবনের
পেশাজীবীদের চেয়ে
অনেকদিনের পরিচিত
বা রাজনীতিবিদদের
সামনে বড়
হওয়া সরকারি
কর্মকর্তা বা
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ
দলের সমর্থক
শিক্ষকরা অধিক
আস্থাভাজন বিবেচিত
কেন, তাও
বুঝেছেন। মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের
একজন রাজনৈতিকভাবে
নিয়োজিত কর্তাব্যক্তির
ভাষায়, ‘নিশানা
ঠিক নেই’
এমন লোক
যতই যোগ্য
হোক না
কেন, রাজনৈতিক
সরকারের উচ্চপদে
যেতে পারবেন
না। তবে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
একজন উপদেষ্টা
বলেছিলেন সবচেয়ে
জোরালো কথা—‘আই
ওয়াজ প্রেজেন্ট,
হোয়াইল ইউর
নেম ওয়াজ
বিংগ ডিসকাসড,
আই টোল্ড
দেম,
ইউ আর
প্রফেশনালি ভেরি
সাউন্ড বাট
উইল অনলি
ডু হোয়াটএভার
ইউ ডিম
অ্যাপ্রোপ্রিয়েট অ্যান্ড
ইউ মে
নট কনসিডার
পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট
অব দ্য
গভর্নমেন্ট’ (তোমার
নাম আলোচনার
সময় আমি
উপস্থিত ছিলাম।
আমি বলেছি,
তোমার রয়েছে
বর্ণাঢ্য কর্ম
অভিজ্ঞতা, কিন্তু
তুমি নিজে
যা ভালো
বোঝো তাই
করবে, সরকারের
রাজনৈতিক বিবেচনাকে
সম্ভবত আমলে
নেবে না)। পাঠকদের
যা-ও
আগে কিছু
সন্দেহ ছিল,
মাননীয় উপদেষ্টার
কথায় নিশ্চয়ই
সব পরিষ্কার
হয়ে গেছে।
ইংরেজিতে একটি
কথা আছে—‘ইউ
অনলি গেট,
হোয়াট ইউ
ডিজার্ভ’ (তোমার
যা প্রাপ্য,
তুমি তা-ই
পাবে)।
আমাদের মতো
একটি বিকাশমান
অর্থনীতি আর
কিছুটা হলেও
শিশু গণতন্ত্রে
হয়তো এর
বেশি আশা
করাও ঠিক
নয়। ‘উইনার
সুড টেক
ইট অল’
(বিজয়ী সব
নেবে)।
প্রায় সর্বশেষ
কথাটি হলো,
‘এ সামহোয়াট
নার্ভাস উইনার
সুড নেভার-এভার
টেক এনি
রিস্ক। কনসিকোয়েন্স
মাইট বি
আনম্যানেজেবল’ (কিছুটা
নাজুক বিজয়ীর
জন্য কোনো
ঝুঁকি নেয়া
হতে পারে
বিপজ্জনক)।
আমি সৃষ্টিকর্তার
ইচ্ছায় অনেক
অনেক ভালো
আছি। তবে
আরেকজন সম্ভাব্য
প্রার্থী, সারা
জীবনের নিবেদিতপ্রাণ
সরকারি কর্মকর্তা
এবং বিশ্বব্যাংকের
সাবেক বিকল্প
নির্বাহী পরিচালকের
ব্যাপারে নাকি
বলা হয়েছিল—সুযোগমতো
তিনি আরেকজন
ড. ফখরুদ্দিন
হয়ে যেতে
পারেন!
দেশের স্বার্থের চেয়ে সরকারে থাকা দলের স্বার্থ বড় হলে এ রকমটিই কিন্তু হওয়ার কথা। আর সারাক্ষণ ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে’ থাকা সরকারের পক্ষে দলীয় বলয়ের বাইরে গিয়ে ‘সাগর সেচে মানিক’ আনাও সম্ভব নয়।
মামুন রশীদ: সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাহী এবং অর্থনীতি বিশ্লেষক