সচরাচর আমাদের রাজধানী ঢাকা বায়ু মান সূচকের তালিকার তলানির দিকে থাকে। অর্থাৎ বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে শীর্ষের দিকে। কিন্তু ঈদুল আজহার পঞ্চম দিনে হঠাৎ এক ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেল। এয়ারকোয়ালিটি ডটকমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার বাতাসের গুণগত মান ওইদিন ‘সহনীয়’ ছিল। স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় বায়ুদূষণের ছয়টি ক্যাটাগরির মধ্যে এটি দ্বিতীয়। অর্থাৎ সে দিন ঢাকার বায়ু পুরোপুরি দূষণমুক্ত না হলেও অতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। এদিন ঢাকার বায়ুর মান টরন্টো, সিডনি, সান্তিয়াগো, মেক্সিকো সিটি, সাংহাই, দিল্লি, লাহোর, লস অ্যাঞ্জেলেস, রিয়াদ, মন্ট্রিয়ল, শিকাগো, করাচি, দুবাই, জাকার্তাসহ ২৫টি শহরের চেয়ে ভালো দেখিয়েছে। বায়ুর মানভিত্তিক এই র্যাংকিং করেছে আইকিউএয়ার ডটকম।
ঢাকার বায়ুর মানের এ ব্যতিক্রমী চিত্র নিয়ে কথা বলছিলাম রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আজ ঢাকার বায়ুর মান এক্সিলেন্ট। কোনো দূষণ নেই। শুধু দূষণ নয়, যানজটও নেই। কেন নেই? এখনো সবাই ঢাকায় ফেরেনি। ফলে গত কয়েক দিন ঢাকার বাসযোগ্যতা সহনীয় মাত্রায় রয়েছে।’
আশরাফুল ইসলামের মতে, ‘ঢাকার বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারে জরুরি কয়েকটি পদক্ষেপ নিলে বিশ্বের সেরা শহরে পরিণত হবে এ শহর। তার যুক্তি, ঈদের পঞ্চম দিনে বেসিক নিডি মানুষজন চলে এসেছে। অফিস-আদালত খুলে গেছে। এখন ঢাকায় যে পরিমাণ মানুষ আছে, এটা যদি ডাবলও হয়, তাহলেও ঢাকার যানজট, এয়ার কোয়ালিটি ফল করবে না। কিন্তু ঢাকায় মানুষ ঢুকবে কয়েক গুণ বেশি। সমস্যা এখানেই।’
রাজউক থেকে বেরিয়ে অফিসের উদ্দেশে আসতে আসতে ফাঁকা ঢাকা দেখে মনে হলো, এ নগরী দুই ঈদের সময় হাঁফ ছেড়ে নিশ্বাস নেয়। প্রায় সময়ই যে ঢাকা দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ওঠে আসে এটা আসলে ঢাকা শহরের নিজের দোষ নয়। দেশের শাসন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ প্রায় সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ঢাকা। তাই চাকরি কিংবা জীবিকার খোঁজে দেশের সব অঞ্চল থেকে ঢাকায় মানুষের আগমন ঘটে। বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ধারণক্ষমতার চার গুণ মানুষ বসবাস করে এবং ১২ গুণ বেশি অবকাঠামো রয়েছে। বিপরীতে সবুজ ও নীল একেবারেই কম। যতটুকু রয়েছে তাও হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঢাকায় মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন, এগুলোর ধোঁয়ায় রাজপথ আচ্ছন্ন থাকে অবিরত। অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামাল দিতে ঢাকায় সব সময় কোনো না কোনো উন্নয়ন প্রকল্প থাকে চলমান। চলমান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালেও যত্রতত্র রাস্তা কিংবা মাটি খননের জন্য প্রচুর ধূলিকণার সমাবেশ ঘটে রাজধানীর বায়ুমণ্ডলে।
তাহলে উপায়? খোদ রাজউকও স্বীকার করছে যে ঢাকা থেকে চাপ কমানোই একমাত্র সমাধান। প্রয়াত স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রায়ই বলতেন, ‘প্রয়োজনে ঢাকায় প্রবেশের জন্য পাসপোর্ট সিস্টেম করে হলেও এ মানুষের স্রোত বন্ধ করতে হবে।’ শুনতে হাস্যকর মনে হলেও কথাটি কিন্তু ফেলনা নয়। তিনি আসলে বোঝাতে চাইতেন, যেকোনোভাবেই হোক ঢাকাকে যেন ভারমুক্ত করা হয়। কিন্তু আমরা দেখছি, ক্রমান্বয়ে ঢাকাকে মানুষ ও অবকাঠামোর চাপে আরো পিষে ফেলছে খোদ রাষ্ট্রই। অথচ এর নাম দিয়েছেন উন্নয়ন! প্রশ্ন হচ্ছে, শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ঢাকাকে চাপমুক্ত করার আর কোনো উপায় আছে?
কিন্তু ঢাকা চাপমুক্ত করতে কী করেছে কর্তৃপক্ষ? একবার এক অনুষ্ঠানে এ প্রশ্ন করলে রাজউকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা অডিয়েন্সের উদ্দেশে বুক ফুলিয়ে বলেন, পূর্বাচল নতুন শহর, ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পসহ কী না করেছে রাজউক! পাল্টা প্রশ্ন করা হলো এতে কি ঢাকা চাপমুক্ত হয়েছে, না প্রকল্পের ভারে আরো ভারাক্রান্ত হয়েছে ঢাকা? দুই যুগের বেশি সময় ধরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞেও পূর্বাচলে আবাসন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। গত ২০ জানুয়ারি বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প: আবাসন নয়, জমির সবচেয়ে বড় বাজার তৈরি করেছে রাজউক।’ ওই প্রতিবেদনে রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেন ভুল নীতির কারণেই পূর্বাচলে বসতি গড়া সম্ভব হচ্ছে না। বরং কয়েক লাখ টাকায় প্লট বরাদ্দ পেয়ে কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করে করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন প্লট মালিকরা। এক কথায়, পূর্বাচলে আবাসন সমস্যা নয়, বরং আলাদিনের চেরাগ বানিয়েছে রাজউক। আর ঝিলিমিল প্রকল্প! এক কথায় যদি বলতে চাই তাহলে বলতে হয়—‘দিল্লি অনেক দূর।’ একটি ইটও গাঁথা হয়নি যে প্রকল্পের তা নিয়ে যত কম বলা যায় ততই মান রক্ষা হবে রাজউকের। ঢাকা চাপমুক্ত করার প্রশ্নে এমন দুটি ব্যর্থ প্রকল্পের উদাহরণ বুক ফুলিয়ে কেবল রাজউকই দিতে পারে। অন্য কেউ হলে লজ্জায় মুখ লুকাত। বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাবে নির্মাণকালেও প্রচুর দূষণ ঘটে জলে, স্থলে ও বায়ুমণ্ডলে।
ফিরে আসি ঢাকার বায়ুদূষণের কথায়। বায়ুদূষণের ফলে নগরীতে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে—এটা পুরনো খবর। নতুন খবর হলো, গর্ভের শিশুও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের প্রভাবে কম ওজন ও অপরিণত শিশু ভূমিষ্ঠের সংখ্যা বাড়ছে। প্রসঙ্গত বলে নিই, একটি অপরিণত কিংবা কম ওজনের শিশুর চিকিৎসায় কী পরিমাণ আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ধকল সামলাতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ভয়ের কথা হলো, বায়ুদূষণই ঢাকার একমাত্র সমস্যা নয়। বাসযোগ্যতার যতগুলো প্যারামিটার আছে সব ক’টিতেই ঢাকার অবস্থান তলানিতে। যেমন রাস্তায় হাঁটার কথা যদি বলি, ঢাকায় কি পথচারীদের হাঁটার কোনো অবস্থা আছে? জনগণের করের টাকায় সিটি করপোরেশন ফুটপাত বানায়, কিন্তু সেখানে রাজত্ব করে হকাররা। রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টদের ‘সন্তুষ্ট’ রাখা ছাড়া হকারদের সাম্রাজ্য এক মুহূর্তও টেকে না সে প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা আজ নাই বা করলাম। কিন্তু চাপমুক্ত ঢাকা বানাতে গিয়ে নগরীর সমস্যা আর যাতে না বাড়ে সে অনুরোধ তো রাজউক সংশ্লিষ্টদের কাছে করতেই পারি।
ঢাকা শহর অতিরিক্ত মানুষ ও এসব মানুষের স্থান সংকুলান করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত অবকাঠামোর চাপে আজ মুমূর্ষু। প্রশাসনের কেন্দ্রীয়করণের ফলে হয়েছে উন্নয়নের তথা উন্নয়নজাত কিংবা অবকাঠামোগত দূষণেরও কেন্দ্রীয়করণ। যেকোনো উন্নয়ন অবশ্যই সাধুবাদের দাবি রাখে। কিন্তু রাষ্ট্রের সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে সুষম উন্নয়ন কাম্য। সব অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ। আর বিকেন্দ্রীকরণ হলে ঢাকা পরিত্রাণ পাবে যানজট কিংবা বায়ুদূষণের মতো অন্যান্য দূষণ থেকেও।
আল ফাতাহ মামুন: সাংবাদিক