যশস্বী আইনবিদ, মানবতাবাদী সমাজতিহৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ জন্মবার্ষিকী। ১৯১১ সালে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম এবং তিনি ইন্তেকাল করেন ঢাকায় ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল।
বিচারপতি মোরশেদ একজন আইনবিদ ও বিচারপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন।
সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অথচ স্বাধীন পেশা হিসেবে তখনো সমাজে আইন পেশার গুরুত্ব অসামান্য। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমলে তারা অন্য পেশাজীবীর তুলনায় রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন অনেক বেশি।
অবিভক্ত বঙ্গে স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল ১৮৪৯-৩ আগস্ট ১৯২৮) কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারক আমীর আলীসহ আরো অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এ সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধ দ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে।
তবে বিচারপতিরা কর্মজীবনে সবাই সমান খ্যাতি অর্জন করেননি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাদের সবার অংশগ্রহণ সমান সপ্রতিভ নয়। এক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ও ব্যতিক্রম। তিনি যেমন ছিলেন তার কর্মক্ষেত্রে তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই তো এক পর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধা করেননি। বিচারপতি জীবনে তিনি অনেকগুলো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে তিনি স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।
বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও অনেকগুলো ভাষায় তার দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখণ্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষেও তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি, তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করে।
জন্ম ও পরিবার: ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের জন্ম। পারিবারিক সূত্রমতে, হযরত ইমাম হোসেনের বংশধরদের একজন, মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির আমলের প্রথম দিকে দেওয়ানি আদালতের বিচারক ছিলেন। তিনি তাদের পূর্বপুরুষদের একজন বলে জানা যায়। মাহবুব মোরশেদের পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বেশ খ্যাতি ছিল।
মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্র্যাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকেই মোরশেদ ছিলেন ঐতিহ্যসম্পন্ন পরিবারের উত্তরাধিকারী।
১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র একেএম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ। তাদের চার সন্তানের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা সাঈদা মোরশেদ। দ্বিতীয় সন্তান (জ্যেষ্ঠ পুত্র) সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তৃতীয় পুত্র সৈয়দ মামনুন মোরশেদ লন্ডন কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ মানসুর মোরশেদ বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পদে কর্মরত আছেন।
শিক্ষা: শিক্ষাজীবনে মাহবুব মোরশেদ একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণীতে তিনি প্রথম হয়েছেন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তিনি ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণীতে এলএলবি ডিগ্রি নেন যথাক্রমে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে।
মেধাবী মাহবুব মোরশেদ ছাত্রজীবনেই বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যেও বিখ্যাত লেখকদের উল্লেখযোগ্য বইগুলোও পড়া শেষ করেন। কলেজ জীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়ও সম্পৃক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদকও ছিলেন একবার। একই সময়ে তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। কলেজ জীবনে তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। ৩০-এর দশকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্বও পালন করেন। সেকালে মুসলমান তরুণদের মধ্যে খেলাধুলায় অংশগ্রহণে একধরনের অনীহা ও অবহেলা ছিল, তরুণ মাহবুব মোরশেদ সেই নেতিবাচক অবস্থা দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আইন পেশায় আত্মনিয়োগ: মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাইকোর্টে অইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষ চন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডসের বিখ্যাত লিংকন’স ইন থেকে বার অ্যাট ল (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বার-এ যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেন। তবে ওই সময়টি ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শেরেবাংলার নেতৃত্বে গঠিত সেই সরকারের কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনায় সময়টা ছিল উত্তাল। এসব ঘটনা নিয়ে তিনিও সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
১৯৫৫ সালে যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন, মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তাদের একজন।
বিচারপতি পদে: মাহবুব মোরশেদ ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৯৫৫ সালের জুন মাসে। দেশে তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এ সময়ে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকও কিছুদিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আইনের শাসনের অবিচল প্রবক্তা ছিলেন।
১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন দেশের উচ্চ আদালতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতরও বটে। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল তৎকালীন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারপতি মোরশেদের অনেক রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টাস্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাইকোর্ট থেকে সুয়োমোটো (স্বপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন, যার ফলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারেনি। বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টেরও (আপলি বিভাগ) অ্যাডহক বিচারক ছিলেন। সেখানেও তিনি তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এর আগে ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল ফেমিন এবং ’৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে তিনি অনেক মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজেও অংশ নিয়েছেন।
বিচারপতি মোরশেদ একজন প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি কখনো কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাননি। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাহসের সঙ্গে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সর্বোপরি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন অন্যতম প্রধান রূপকার, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
লেখকঃ আতিক হেলাল, কবি ও শিশুসাহিত্যিক