সময়ের ভাবনা

খরার ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি

৩ আগস্টের ইব্রাহিম থিয়াওয়ের লিখিত টেকসই উন্নয়নে খরা মোকাবেলার জন্য কী করা যায়, সে ব্যাপারে একটি বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করেছে বণিক বার্তা। অনুবাদ করেছেন হুমায়ুন কবির। এ পত্রিকাটি এ ধরনের অনুবাদ প্রায় প্রকাশ করে, যা বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো। ধন্যবাদ জানাই বণিক বার্তাকে এ ধরনের নিবন্ধ প্রকাশের জন্য। এতে আন্তর্জাতিক গবেষকদের ধ্যানধারণা পেতে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

আগস্টের ইব্রাহিম থিয়াওয়ের লিখিত টেকসই উন্নয়নে খরা মোকাবেলার জন্য কী করা যায়, সে ব্যাপারে একটি বিস্তারিত  নিবন্ধ প্রকাশ করেছে বণিক বার্তা। অনুবাদ করেছেন হুমায়ুন কবির। পত্রিকাটি ধরনের অনুবাদ প্রায় প্রকাশ করে, যা বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো। ধন্যবাদ জানাই বণিক বার্তাকে ধরনের নিবন্ধ প্রকাশের জন্য। এতে আন্তর্জাতিক গবেষকদের ধ্যানধারণা পেতে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তথ্য এবং এর বাইরেও তাদের মতামত জানতে পারা যায়। বিশ্বে কোথায় এবং কীভাবে এগুলো দেখা হচ্ছে তার একটা পরিচয় পাওয়া যায়।  

নিবন্ধে খরা সম্পর্কে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে তা সত্যি ভয়াবহ। দক্ষিণ ইউরোপ, ইতালি, চিলি, মেক্সিকো যে ধরনের খরা পরিস্থিতির শিকার তা সত্যিই পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য বিপত্সংকুল বার্তা দিচ্ছে। বাংলাদেশকেও হয়তো কোনোদিন মেক্সিকোর মন্টেরির মতো পানি রেশনিং করতে হতে পারে, যদি না বিশ্ব গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে আরো দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়। ধরনের সতর্কবাণী আরো অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পাওয়া যায়। এখন প্রয়োজন কীভাবে তৈরি হতে হবে, যাতে ধরনের পরিস্থিতিতে কাউকে পড়তে না হয়।  সম্প্রতি আমরা দেখলাম, ইউরোপের দাবানল ক্রমে খরা পরিস্থিতিকে তীব্র করে তুলছে, আরো দুঃসংবাদ, জাতিসংঘের নতুন ঘোষণায় বলা হয়েছে, রকম দাবদাহ আরো দেখা যাবে, এসব বিশ্ববাসীর জন্য আতঙ্কের কারণ।

খরার সঙ্গে সবচেয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে বিষয়টি তা হলো কৃষির ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জমির ক্ষয় এবং খরার কারণে কৃষির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। প্রায় ছয় মিলিয়ন হেক্টর জমি অথবা প্রায় ৪৩ শতাংশ ভৌগোলিক এলাকা বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের শিকার। জমির উর্বরতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য অবক্ষয়, অতিরিক্ত উৎপাদন, ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ, জলাবদ্ধতা আরো কিছু ফল এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও আমাদের সীমিত চাষযোগ্য জমি ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর চাপ যা ক্রমাগত বনায়ন ধ্বংস করছে, অতিমাত্রায় ভেজিটেশন রিসোর্সের ব্যবহারও খরা এবং অন্যদিকে চাষযোগ্য জমি কমিয়ে ফেলছে। অতি বন্যা, কম বৃষ্টির ফলে শুষ্কতা কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাসের কারণ হয়ে উঠতে পারে, যা জীবনযাত্রার মানে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ইদানীং কৃষিজমি রিয়েল এস্টেটদের হাতে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি সুযোগ হয়েছিল পদ্মা সেতু দেখার। সেতু পার হওয়ার পর অসংখ্য সাইন বোর্ড চোখে পড়ল জমি বিক্রির। লেখা আছে, স্বাগত জন্মভূমি সিটি, মাতৃভূূমি সিটি, মডার্ন গ্রিন সিটি, এশিয়ান টাউন সিটি (শান্তিনিবাস), নতুন ধরা, ব্রাকেটে লেখাপরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ছাড়পত্রপ্রাপ্ত, ধরিত্রি প্রপার্টি, সিলভার গ্রিন সিটি  ইত্যাদি, কটা মনে রাখতে পেরেছি তবে আরো অনেক আছে।  অর্থাৎ সেতু চালু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব জায়গার মান এবং দাম বেড়ে গেছে। কাজেই নতুন ব্যবসাও বেড়েছে। এর বেশির ভাগই চাষযোগ্য জমি, যা বর্তমানে শহরে রূপ নিতে যাচ্ছে। এখনো বেশ সবুজ এলাকাগুলো, তবে অচিরেই কংক্রিটের গাঁথুনিতে সবুজ হারিয়ে যাবে। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশ ১৪ দশমিক মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি, এর মধ্যে ৫৯ দশমিক শতাংশ আবাদযোগ্য। যেখানে জনসংখ্যা বাড়ছে, খাদ্যচাহিদা বাড়ছে সেখানে আবাদযোগ্য জমি বাড়ানোর সঠিক পরিকল্পনাও জরুরি।

বিশ্বের বহু দেশে এগ্রো-ফরেস্ট্রি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যা জমির মান সংরক্ষণ এবং পরোক্ষভাবে খরা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে গাছ, মাটি, শস্য, গবাদিপশু সবার মিথস্ক্রিয়ার ফলে যে উৎপাদন ব্যবস্থা তা ব্যাপকভাবে  জমির মান ধরে রাখতে ভূমিকা রাখতে পারে। পদ্ধতি টেকসই উৎপাদন এবং কার্বন নিঃসরণে অবদান রেখে একদিকে যেমন আয় বাড়িয়ে জীবনমানের উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে সহায়ক, অন্যদিকে সামাজিক সমতা বিধানেও অবদান রাখতে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা এবং ইউএনসিসিডি বা ইউএন কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশন খরার ঝুঁকি কমানোর কিছু উদাহরণ দিয়েছে। ইউএনসিসিডির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি বলেন, আমরা পৃথিবীর বরফমুক্ত চার ভাগের তিন ভাগ জমি আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে যেমন খাদ্য, কাঁচামাল ইত্যাদির জোগানে ব্যবহার করে ফেলেছি। তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী জমির ক্ষয়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত। জমির ক্ষয় জলবায়ু পরিবর্তনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে।

ইউএনসিসিডি একটি রিও কনভেনশন (এজেন্ডা ২১) যা ১৯৯৪ সালে গ্রহণ করা হয়েছে, এটি বাস্তবায়িত হয়েছে ডিসেম্বর ১৯৯৬ থেকে। এটাই খরার ক্ষেত্রে একমাত্র বাইন্ডিং কনভেনশন, যাকে টেকসই উন্নয়ন এবং গুড গভর্ন্যান্সের একটি মানদণ্ড হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এতে সংযুক্ত আছে ১৯৬টি পার্টি বা দেশ। আন্তর্জাতিক বিশ্ব খরা এবং জমির ক্ষয়কে একটি অন্যতম সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখেছে। ১৯৭৭ সালে খরা নিরসনে একটি অ্যাকশন প্লান গ্রহণ করা হয়েছিল। খরায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল আফ্রিকা। বাংলাদেশ গত ১৪ অক্টোবর কনভেনশনটি স্বাক্ষর করে এবং ২৪ জানুয়ারি ১৯৯৬- এটি রেটিফাই করে পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে খরা নিরসনে কিছু দায়িত্ব রয়েছে।

পরিবেশের পরিবর্তন এবং মনুষ্য কর্মকাণ্ড হলো দুটি প্রধান কারণ। যে কারণে খরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আমরা অতিমাত্রায় বনজ কাঠ কেটে ফেলেছি, কৃষি কর্মকাণ্ড এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ইকোসিস্টেমের ওপর প্রভাব পড়েছে। অর্থাৎ যেখানে কম বা মাঝারি বৃষ্টিপাত হয় অথবা কিছুটা শুষ্ক বা বৃষ্টিপাত হীন এবং আধা শুষ্ক অনুর্বর সেখানেও কৃষির চেষ্টা করেছি, ফলে জমির ক্ষমতার ওপর প্রভাব পড়েছে। যেমন বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, মধুপুর অঞ্চল কিছুটা খরাপ্রবণ জায়গা। এখানে এমন ফসল আবাদের প্রচেষ্টা নেয়া দরকার, যা প্রকৃতিসহনশীল। 

খরার প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রাণী থেকে মানব দেহে সংক্রমণ হয়েছে। এর প্রকোপও বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের কভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমরা প্রাণী জগতের অবাধ বিচরণ ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত করেছি, ফলে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে এসেছে, জীব-বৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। ধরনের ভাইরাসজনিত রোগ ভবিষ্যতে বাড়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।

আমাদের এখন দরকার অনেক বেশি করে গাছ লাগানো, গাছের  শেকড় মাটিকে একসঙ্গে ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং মাটির ক্ষয় রোধ এবং পরিমিত বাতাস এবং বৃষ্টি পেতে সাহায্য করে। ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করা দরকার, যাতে তারা মাটির গুণগত মানোন্নয়নে এগিয়ে আসে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নিয়ে নানা ধরনের নতুন মডেল নিয়ে এসেছে। আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা নিশ্চয় এটি নজরে এনেছেন, ব্যাপারে আরো সচেতনতা বাড়ানো দরকার।

একই সঙ্গে আমাদের দরকার জলবায়ুসহিষ্ণু প্রযুক্তির। সেদিকে আমাদের  যেতে হবে। খরা নিরসনে সবচেয়ে যা বেশি দরকার তা হলো পানির দক্ষ ব্যবহার। কৃষিতে সেচের প্রয়োজন পড়বেই। কীভাবে কাজটি পরিবেশের কম ক্ষতি করে পরিচালনা করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে কাজ। বিশেষ করে যেমন ভূ-উপরিস্থ পানি সেচে ব্যবহার করতে পারি।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণ যেভাবেই হোক কমিয়ে আনতে হবে। এটা আমরা কমিয়ে না আনতে পারলে ২০৬০ সালে এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে। বিজ্ঞানীরা আরো ধারণা করেন, আমাদের তাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখার সক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং তাতে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা জটিলতার প্রকাশ আমরা ঘন ঘন দেখতে পাচ্ছি, ব্যাপারে আমাদের বিশেষ করে সাধারণের কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত যারা তাদের সবার সচেতনতা অনেক বাড়াতে হবে।

 

ফেরদাউস আরা বেগম: প্রধান নির্বাহী

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)

আরও