বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে সৌদি আরবের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমবিকাশমান। ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনুষঙ্গের পাশাপাশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়ায় এটি সম্ভব হয়েছে। তবে অনেক সময় নানা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। সম্প্রতি এ নিয়ে অভিযোগও প্রকাশ করেছেন সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত। তিনি জানিয়েছেন যে বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা করেও পারেনি সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত একটি তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি দল তিন দফায় বাংলাদেশে এলেও স্বাগত জানানো হয়নি। এর পরও সে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তেল শোধনাগার নির্মাণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুসংবাদই বটে।
তবে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে শ্রমবাজারের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। সৌদি আরবকে এদিকেও নজর দিতে হবে।
সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছে। কিন্তু সে দেশ থেকে মাথাপিছু রেমিট্যান্স কম আসে। কারণ দেশটিতে প্রতিযোগিতামূলক দক্ষ ও উচ্চ বেতনের চাকরিতে নিয়োজনের দিক থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা পেছনের সারিতে অবস্থান করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসীরা প্রশিক্ষিত না হওয়ায় প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ ও বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। এ বাস্তবতায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিশেষ কাজে দক্ষতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রদান করবে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে।
সুতরাং বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষিত শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারেও সৌদি আরবকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী এ দেশের কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরির বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। সৌদির শ্রমবাজারে প্রশিক্ষিত কর্মীর সংখ্যা বাড়লে তা রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
এর পাশাপাশি সৌদি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে। বিগত সরকারের আমলে দেশে প্রত্যাশিত হারে বিনিয়োগ বাড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ ২২-২৩ শতাংশেই আটকে আছে। এর পেছনে বহু আগে থেকে বিদ্যমান নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট—ডলার ঘাটতি, রিজার্ভ ক্ষয়, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, নীতির ধারাবাহিকতাহীনতা ইত্যাদির দায় রয়েছে। আবার বিনিয়োগ না বাড়ায় সংকটগুলোও তীব্র হয়েছে। কেননা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চক্রাকারে একে অন্যকে প্রভাবিত করে। বিনিয়োগ নিম্নগামী হওয়ার অর্থ হলো অর্থনীতির চাকার গতি শ্লথ হয়ে আসা। পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে শিল্প উৎপাদন ক্রমে কমে তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ব্যাহত হয়। কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, যা বেকারত্বের হার বাড়ায়। আর অর্থনৈতিক এসব সংকট শিল্প উৎপাদন হ্রাস, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ইত্যাদি যদি আগে থেকে বিদ্যমান থাকে তাহলে সেগুলো বিনিয়োগ পরিবেশের অবনমন ঘটায়। আর এর বর্তমান প্রতিফলন বাংলাদেশ। উপরন্তু যোগ হয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা যা বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে এক ধরনের স্থবির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে এবং বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে সেভাবে এ প্রবৃদ্ধি ঘটেনি।
এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বাড়াতে চাওয়া সুখবরই বলা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন সৌদি আরবের বিনিয়োগের পথ প্রশস্তের উদ্যোগ নেয়া। এর আগেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এক সাক্ষাতে সৌদি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাধা দূর করার জন্য। তিনি আরো জানিয়েছিলেন যে সৌদি আরব বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি ও লজিস্টিকে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। সুতরাং অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বিনিয়োগ বাধাগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে ও সমাধানে তৎপর হওয়া প্রয়োজন। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিনিয়োগ ধরে রাখার প্রতিও জোর দিতে হবে। সৌদি আরব বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজারের পাশাপাশি অর্থনীতিতে অন্যতম বিনিয়োগকারী হিসেবে আবির্ভূত হলে তা দেশের জন্য বহুমাত্রিক সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে জ্বালানি রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশ সৌদি আরবের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারবে। সৌদি আরব যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদনে সহায়তা করে তাহলে তা দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ অবারিত করবে। এতে সৌদি আরবের পাশাপাশি আরো অনেক বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। দিন দিন দেশে বেকারত্বের হার বৃদ্ধির বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে বেকার, বিশেষত শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে। তাই সৌদি বিনিয়োগ এলে বা তাদের বিনিয়োগে কোম্পানি গড়ে উঠলে সেখানে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হবে।