বাংলাদেশ দীর্ঘদিন পরিচয়ভিত্তিক রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। মূলত দুটি প্রভাবশালী মতাদর্শই বিগত সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে, একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যটি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। উভয় মতাদর্শই স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এ জাতির পরিচয় গঠনে অবদান রাখলেও ইতিহাসের এ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ, যেমন বিশ্বায়ন, বিবর্ধিত জনসংখ্যা, ভবিষ্যতের মাল্টিকালচারাল বা বহুসংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি মোকাবেলায় পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
এ বাস্তবতার নিরিখে দাঁড়িয়ে আমরা যদি ভবিষ্যৎকে কল্পনা করতে চাই যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রগতিশীল এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভক্তিকে দূর করে একটি অভিন্ন অভিযোজিত কাঠামো দাঁড় করাবে তা হচ্ছে নাগরিক জাতীয়তাবাদ। এ মতাদর্শের মূলে রয়েছে সমতা, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, যা বাংলাদেশের মতো হোমোজেনাস বা সমজাতীয় সমাজে নাগরিকদের একত্রিত করে ভবিষ্যতের বহুসংস্কৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে একটি সমন্বিত মডেল দাঁড় করিয়ে দেবে।
প্রথমেই প্রশ্ন আসবে, সিভিক বা নাগরিক জাতীয়তাবাদ আসলে কী? নাগরিক জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যা নাগরিকত্বের সাম্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং জাতিগত, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পার্থক্য নির্বিশেষে ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে জাতীয় পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করে। এটি এমন এক ধরনের জাতীয়তাবাদ যা পারস্পরিক মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এবং নেতৃত্ব থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেই একই মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। অন্য যেকোনো জাতীয়তাবাদ থেকে এর পার্থক্য হলো, এটি কোনো পরিচয়ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ নয়, বরং এটি এমন এক মতাদর্শ যা জনগণকে জাতিগত, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের পরিবর্তে কোনো ধারণা, পারস্পরিক মূল্যবোধ, নাগরিকত্ব, সমতা ও গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি অঙ্গীকারের ভিত্তিতে একত্রিত করে। এটি আইনের শাসনের অধীনে সাম্য, অন্তর্ভুক্তি ও সুশাসনের ওপর জোর দেয় এবং জনগণের মাঝে এমন এক একাত্মবোধের জন্ম দেয় যা সাংস্কৃতিক বা পরিচয়ভিত্তিক ভেদাভেদ দূর করে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে একটি প্রধান ভাষা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিসত্তা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম রয়েছে, সেখানেও আমরা বিভক্তি দেখতে পাই। সেই বিভক্তি রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, আর্থসামাজিক এবং অনেক জায়গায় বর্ণ ও শ্রেণীগতও হয়ে থাকে। এমনকি একই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনও আমাদের সমাজে দেখা যায়। সেখানে নাগরিক জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী কাঠামো প্রদানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ একই সঙ্গে উদার বিকল্প হতে পারে। এটি শুধু বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সংহতি নিশ্চিত করে না, বরং বিশ্বায়ন, অভিবাসন বা জনসংখ্যার স্থানান্তরের মতো চ্যালেঞ্জগুলোর ভেতর থেকে একটি বহুসংস্কৃতির মেলবন্ধনে ভবিষ্যতের জন্যও পুরো জাতিকে প্রস্তুত করে তুলতে পারবে।
এবারে আসি, বর্তমান যে দুটি বড় জাতীয়তাবাদ আমাদের সামনে রয়েছে সেগুলোর সমস্যাগুলো কী কী।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সামনে আনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের হাত ধরে আবির্ভূত হয়েছিল। জাতি হিসেবে বাঙালি—এ ধারণা সামনে রেখে ভাষা, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে যুক্ত করে তৈরি করা এ জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রথম সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এ জাতীয়তাবাদের একদম প্রাথমিক ও মূল সমস্যা হচ্ছে এর জাতি-ভাষাগত দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্নিহিতভাবে অবাঙালি গোষ্ঠীগুলো বাদ দিয়ে দেয়, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় এবং ভিন্ন ভাষাভাষী অভিবাসী সম্প্রদায় (যেমন বিহারি, রোহিঙ্গা কিংবা আটকে পড়া পাকিস্তানি), যারা এ বাঙালি সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। এ জাতীয়তাবাদের একচেটিয়া শাসন ব্যবস্থা বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কাঠামো হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, জাতি-ভাষাগত পরিচয় থেকে একটি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিএনপির হাত ধরে, যা একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে জাতিগত বা ধর্মের পরিবর্তে রাষ্ট্রের মধ্যে নিহিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের ওপর জোর দেয়। এটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এটি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বাইরে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টায় একচেটিয়াভাবে ‘বাঙালি’ না হয়ে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে অবস্থান প্রকাশ করে। যদিও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মতাদর্শ হিসেবে অনেক বিস্তৃত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, তবুও পারস্পরিক মূল্যবোধ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির ক্ষেত্রে এর নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রথম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে রাষ্ট্রনির্ভরতা। মতাদর্শটি তার ঐক্যবদ্ধ প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। কিন্তু আমরা যদি পৃথিবীর ম্যাপের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, রাষ্ট্রের কাঠামো সর্বদা পরিবর্তনশীল। এ পরিবর্তন পুনর্গঠন, নাম পরিবর্তন বা খণ্ডিতকরণের মাধ্যমে হতে পারে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো বর্তমান অবস্থায় ছিল না, আবার ১০০ বছর পরও যে বর্তমান অবস্থায় থাকবে সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে এ পরিবর্তনের মাধ্যমে এ রাষ্ট্রনির্ভর জাতীয়তাবাদের আদর্শ তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে এবং বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে ব্যর্থ হতে পারে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বৈচিত্র্যের জন্য এতে পর্যাপ্ত কাঠামো নেই। বিশ্বায়ন বা অভিবাসনের কারণে বাংলাদেশ যদি ভবিষ্যতে আরো বহু সাংস্কৃতিক হয়ে ওঠে, এখানে যদি ভিন্ন পরিচয়ের বা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের আগমন ঘটে, তাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে নতুন পরিচয় ও সংস্কৃতিকে কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা বিশাল ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী যদি দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় এবং তারা নিজেদের বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দিতে না চায়, সেক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের আদর্শ বা পরিচয় কী হবে সে ব্যাপারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ উত্তর দিতে পারে, নতুন নামে কোনো রাষ্ট্র গঠন হলে সেই নামেই তখন নতুন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠবে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের অন্য অংশের জনগোষ্ঠী যদি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিচয়ে পরিচিত না হয়ে জাতিগত পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তখন বিপত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সুতরাং বর্তমানে রাষ্ট্র রাজনৈতিক আকারে পরিবর্তন না হলেও বা অন্য জনগোষ্ঠী এখানে সংযুক্তি না ঘটলেও বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বের নিরসনেও নতুন কোনো মতাদর্শের প্রয়োজন।
এখানে আমরা দেখতে পাই, উভয় মতাদর্শই প্রকৃতিগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জাতিগত বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিচয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। বিশ্বায়নের এ যুগে যেখানে পৃথিবী আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠছে, এমনকি হোমোজেনাস সমাজেও, এ জাতীয়তাবাদের কাঠামোগুলো সামাজিক বিভাজনকে আরো স্পষ্ট করে তুলছে, সংখ্যালঘুদের মূল ধারা থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করছে এবং পরিবর্তনের জন্য দেশের অভিযোজন ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলছে।
এ দুই মতাদর্শই আইনের শাসনের চেয়ে পরিচয়গত দিকটাই বেশি সামনে নিয়ে আসে। ফলে তা রাজনৈতিক মেরুকরণ আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে নিজেদের সমর্থন বৃদ্ধি করার জন্য পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে এ দুই মতবাদ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে কিংবা রাষ্ট্র গঠনের সময়ে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় ডিজাইন করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বা ডিজিটাল রূপান্তরের মতো আধুনিক চ্যালেঞ্জগুলো এ মতাদর্শদ্বয় পর্যাপ্তভাবে মোকাবেলা করতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন নাগরিক জাতীয়তাবাদকে এ সমস্যাগুলোর সমাধান হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো তুলনামূলকভাবে সমজাতীয় সমাজেও ভাষা, জাতি, ধর্ম, আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং আর্থসামাজিক অবস্থার দিক থেকে ভেদাভেদ বিদ্যমান। আদিবাসী গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলো প্রায়ই জাতীয় আলোচনা থেকে বাদ অনুভব করে। নাগরিক জাতীয়তাবাদ তাদের একটি ঐক্যবদ্ধ কাঠামো প্রদান করতে পারবে যা ধর্মীয়, জাতিগত, বা আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক বিভাজনকে কমিয়ে এনে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত বোধ করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং এও নিশ্চিত করবে যে সব ব্যক্তিকে তাদের পরিচয় নির্বিশেষে নাগরিক হিসেবে সমানভাবে মূল্য দেয়া হবে, তার সুশাসন নিশ্চিত করা হবে, সে সুবিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করবে এবং সমানভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণের অংশীদার হবে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেমন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সামনে আনার মাধ্যমে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীকে আলাদা করে ফেলেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিচয়কে সামনে তুলে আনার ফলে রাষ্ট্রের কাঠামো বা নাম পরিবর্তিত হলে কী হবে তার কোনো উত্তর দিতে ব্যর্থ, ঠিক সে জায়গায় নাগরিক জাতীয়তাবাদ সব নাগরিককে সমানভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করে যে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় মুছে না দিয়ে সম্পূর্ণরূপে একক জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। আবার একটি রাষ্ট্রের ভৌত বা রাজনৈতিক অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রের কাঠামো বা নাম পরিবর্তিত হলেও স্থিতিস্থাপকতা এবং ধারাবাহিকতা প্রদান করবে। ফলে যদি রাষ্ট্রের আকার বা আকৃতিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসে বা নতুন ভিন্ন সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি ঘটে তবুও এটি ভৌগোলিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতীকবাদের পরিবর্তে জনগণের পারস্পরিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে একটি জাতীয় পরিচয় তৈরি করবে।
নাগরিক জাতীয়তাবাদ পরিচয়ের রাজনীতি থেকে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার মতো মূল্যবোধের দিকে মনোনিবেশ করে। রাষ্ট্রের কাঠামো, নাম বা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন যা-ই হোক না কেন এ মানগুলো সব সময় অনুসরণ করা হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় বিভাজনের পরিবর্তে আইনের শাসন এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে জাতীয় ঐক্যকে সুসংহত করবে। এটি দুর্নীতি, অসমতা এবং আঞ্চলিক বৈষম্যের মতো সমসাময়িক সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য আরো শক্তিশালী এবং টেকসই কাঠামো প্রদান করবে। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে মেরুকৃত সমাজে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে পরিচয়ের রাজনীতি প্রায়ই বিভাজন গভীর করতে ব্যবহৃত হয়েছে।
নাগরিক জাতীয়তাবাদ অন্তর্নিহিতভাবে দূরদর্শী। এটি একটি গতিশীল কাঠামো প্রদান করবে যা সমাজের চাহিদার সঙ্গে বিকশিত হবে। নাগরিক জাতীয়তাবাদ উন্নততর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্বকে উৎসাহিত করে। ফলে বৈশ্বিক নিয়মের সঙ্গে মূল্যবোধকে সংযুক্ত করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি প্রগতিশীল, অগ্রসর-চিন্তাশীল এবং অভিযোজিত জাতি হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানকে উন্নত করে তুলতে সাহায্য করবে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিক জাতীয়তাবাদে রূপান্তর করতে পারে বা নতুন কোনো রাজনৈতিক দল কীভাবে এ মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ওপর নির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে এবং আধুনিক শাসনের জটিলতাগুলো মোকাবেলায় পরিচয়কেন্দ্রিক মতাদর্শের সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্বীকৃতি দিতে হবে। পরিবর্তে তারা সমান নাগরিকত্ব, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সমতা ও আইনের শাসনের ওপর জোর দেয়া নাগরিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি প্লাটফর্ম গ্রহণ করতে পারে। নাগরিক জাতীয়তাবাদ গ্রহণের মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সব নাগরিককে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত পরিচয়ভিত্তিক বর্ণনার চেয়ে পারস্পরিক নাগরিক আইডিয়া, আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়া। নাগরিক জাতীয়তাবাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির প্রয়োজন, যা সব নাগরিকের চাহিদা পূরণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই এমন নীতিগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রান্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য আইনি সংস্কার ও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু অধিকারের সুরক্ষা এবং আঞ্চলিক সম্পদের ন্যায়সংগত উন্নয়ন ও বণ্টন।
বিশ্বজুড়ে নাগরিক জাতীয়তাবাদ অনুশীলন হয়ে আসছে অনেক দেশেই। বেশ কয়েকটি দেশে নাগরিক জাতীয়তাবাদের সফল উদাহরণ রয়েছে। এর প্রথমেই রয়েছে বহু সংস্কৃতির সমাজ কানাডা, যা নাগরিক মূল্যবোধের মাধ্যমে বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করে। ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস’ নিশ্চিত করে যে সব নাগরিকের প্রতি দল, মত, সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সমানভাবে আচরণ করা হয়। এর পর উদাহরণ দেয়া যায় ফ্রান্সের। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ফ্রান্সের নাগরিক জাতীয়তাবাদ সব নাগরিকের জন্য ‘স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্ব’ এ মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উদাহরণ হিসেবে আসবে সিঙ্গাপুরের নাম। অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জাতিগত এবং ধর্মীয় অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সিঙ্গাপুর। পারস্পরিক মূল্যবোধ এবং মেধাতন্ত্রের মাধ্যমে ঐক্যের প্রচার করে থাকে দেশটি। বাংলাদেশ নাগরিক জাতীয়তাবাদকে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে উপযোগী করার সময় এ উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
নাগরিক জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের জন্য বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে একটি ঐক্যবদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অভিযোজিত কাঠামো প্রদান করবে যা দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে এবং জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি করে। এটি আইনের শাসনের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করতে পারবে যা সমতা, ন্যায়বিচার এবং নাগরিক সাম্যকে মূল্য দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য, নাগরিক জাতীয়তাবাদ গ্রহণ শুধু একটি কৌশলগত বিষয় নয়, বরং একটি ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যও জরুরি।
পৃথিবী যেমন বিকশিত হচ্ছে, তেমনি আমাদেরও বিকশিত হতে হবে। বাংলাদেশ যখন উন্নয়ন এবং সম্ভাব্য বৈচিত্র্যের একটি নতুন যুগে রূপান্তরিত হচ্ছে, নাগরিক জাতীয়তাবাদকে আদর্শ বা কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অগ্রসর-চিন্তাশীল সমাজ হিসেবে উন্নতি লাভ করতে পারবে।
জাবেদ রাসিন: লেখক ও আইনজীবী