মন্ত্রিপরিষদ সভায় নতুন আয়কর আইন-২০২৩-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন হওয়ার পর এটি এখন জাতীয় সংসদে। নীতিগত অনুমোদনের বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ থেকে জানানো হয়েছিল, এ আইনের ফলে আয়কর নির্ধারণে কর্মকর্তার ক্ষমতা কিছুটা কমানো হয়েছে। সেই সঙ্গে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন প্রদান আরো সহজ করা হবে। ব্যবসায়ীদের আয়কর নির্ধারণে আগে ২৯টি বিষয় মানদণ্ড ছিল। এখন তা কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মানুষ যাতে ট্যাক্স দিতে উৎসাহিত হয় এবং ট্যাক্সের পরিধি যাতে বাড়ে সেজন্য আইনটি করা হয়েছে উল্লেখ করে আরো বলা হয়, ‘করদাতার করের পরিমাণ আয়কর কর্মকর্তার নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষমতা থাকছে না এ আইনে। করদাতার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কর নির্ধারিত হবে। কর্মকর্তার চাপিয়ে দেয়া করের পরিমাণ ঠিক করার বিধান বাতিলের ফলে আপিলের পরিমাণ কমবে, কমবে করদাতার হয়রানি।’ খসড়া আয়কর আইনে আরো অনেক অভিনবত্ব থাকলেও আইনটিকে আরো করদাতাবান্ধব করার বিষয়টি সামনে আনার মাধ্যমে আইন প্রণয়নকারীরা আইনটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ওপর মন দিয়েছেন এটা বোঝা যায়। নির্বাচনী বাজেটবর্ষে সংসদে কণ্ঠভোটে আয়কর আইন পাস এবং উপহার দেয়ার উপায় নির্মাণে সময়সীমা সেভাবেই সাজানো হয়েছে বহু বছর ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টির। রাজস্ব আহরণের অন্যতম আইন, প্রত্যক্ষ করের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহনকারী আয়কর আইনটির প্রয়োগ পদ্ধতিটাকে যতটা যুক্তিযুক্ত ও জটিলতামুক্তকরণ সম্ভব, সে দাবি ও প্রত্যাশা থেকে দৃষ্টি সরানোর সুযোগ না থাকা ভালো। লক্ষণীয় হলো আইনটির মুসাবিদা হয়েছে যারা আইনটি বাস্তবে প্রয়োগ করবেন তাদেরই হেঁসেলে। যাদের জন্যে এ আইন, যারা এর দ্বারা রাষ্ট্রকে কর প্রদানে প্রণোদিত হবেন, দায়িত্বশীল হবেন তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কতটা এখানে প্রশমিত হবে সেটা দেখার জন্য তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময়, সুপারিশ, পরামর্শ ও পর্যালোচনার সুযোগকে সীমিত করে বা রেখেই আইনটি জাতীয় সংসদে তড়িঘড়ি করে পাস করানোর পথে যেন যেতে না হয় সেটি আইনটির কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থেই দেখা উচিত। ২০১২ সালে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন পাসের প্রেক্ষাপট এবং এর প্রয়োগ প্রবর্তনে প্রায় দুই হালি বছরের টানাটানির অভিজ্ঞতা থেকেই এ প্রসঙ্গটি এসে যায়।
যদিও আইএমএফের ইসিএফ প্রাপ্তির ট্রিগার বা শর্ত পালনের প্রেক্ষাপটে বিদেশের বেস্ট প্র্যাকটিস আমদানি করে প্রণীত মূসক আইনের খসড়া স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা মতবিনিময় করেই সংসদে পাস করা হয়েছিল, সংসদে তখনো প্রায় ৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী বা মূসকের স্টেকহোল্ডার ছিলেন, তারা এটি পাস করেছিলেন, সেই স্টেকহোল্ডাররাই এটি প্রবর্তনে দ্বিমত প্রকাশ করায় বারবার পিছিয়ে যায় এর প্রবর্তন। সুতরাং ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ পরিস্থিতির উদ্ভব আয়কর আইনের ক্ষেত্রে যাতে না হয় সেটি যথা বিবেচনায় আনা বা রাখার দায়িত্ব আমজনতা করদাতাদের পক্ষে তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদের আইনপ্রণেতাদের। নির্বাহী বিভাগের মুসাবিদাকৃত আয়কর আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করা আইন হতে হলে ‘জনমত যাচাই’-এর সুযোগকে কাজে লাগানো এবং নির্বাহী-নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থেকে যাবে। এটা উপেক্ষা করে পাস করা আইন অতীতের বহু আইনের মতো অপ্রয়োগযোগ্য কিংবা অপপ্রয়োগের সুযোগ সন্ধানে বারবার সংশোধনের জিকির, ফন্দি ও দাবি উঠতেই থাকবে। উল্লেখ্য যে, মূসক আইনটি জন্মিয়াও জন্মলাভ করতে পারেনি, প্রবর্তনের আগেই আইনটি সংশোধনের দাবি উঠেছিল। স্টেকহোল্ডাররা বলেছিলেন, ‘আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি, আমাদের সব অভিমত, অনুরোধ ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।’ এখনো বাজারে গুঞ্জন রয়েছে যে আয়কর আইনের ওপর আলাপ-পরামর্শ সভা ছিল অতি নির্বাহী পরিবেষ্টিত পরিবেশে, সেখানে যেসব স্বাধীন অভিমত ও সুপারিশ উঠে এসেছিল, সেগুলোর সবটা খসড়ায় প্রতিফলিত হয়েছে কিনা জানার সুযোগ অবারিত ছিল না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইনটি সবার দৃষ্টিগোচর করা না হলে এটি সংসদে অনুমোদনের আগে গণঅবহিতির ক্ষেত্রে ‘গোপনীয়তা’র নীতি অবলম্বন করা হলে আইনটির গ্রহণ ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হতে পারে।
সবাই জানেন এবং মানেন যে বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর আইনটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে এখনো নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক প্রতীয়মান হয়। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সেবার বিনিময়, কিংবা উৎপাদন বা সম্পদ ব্যবহার বাবদ নানান নামে নানান উপায়ে রাজস্ব বা টোল বা সেস আদায়ের প্রথা সেই আদি যুগ থেকে চলে এলেও আধুনিক আয়কর বলতে যে বিশেষ কর রাজস্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত, এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সাত সাগর তেরো নদীর পার থেকে আসা বিদেশী বেনিয়াদের দ্বারা। তাদের তৎকালীন সমাজে শিল্প বিপ্লবের পর পুঁজির প্রসার ঘটে এবং সেখানে সম্পদের ওপর, সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত আয় অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ওই অতিরিক্ত আয়ের ওপর একটা হিস্যা দাবি করে বসে, যুক্তি এই, তুমি রাষ্ট্রের তৈরি অবকাঠামো ব্যবহার করে আয় উপার্জন করছ, রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা ভোগ করে লাভবান হচ্ছ সুতরাং এসব অবকাঠামো নির্মাণ, এসব সুযোগ-সুবিধার সমাহার বাবদ রাষ্ট্রের বিনিয়োগে তোমার অংশগ্রহণ চাই।
এ দেশে যারা আয়কর আইন আমদানি করেছিলেন, যে সময়ে এনেছিলেন, যাদের জন্য এনেছিলেন এবং যাদের ওপর অর্পিত হয়েছিল এর প্রয়োগ-প্রবর্তনের ভার তাদের প্রত্যেকের নাড়িনক্ষত্র পরীক্ষা ও পর্যালোচনায় বিদ্যমান আয়কর আইনের চরিত্র ও চারিত্র্য, এর শরীর ও শারীর শনাক্তকরণ সহজ হতে পারে। আমরা জানি এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। রেজা খান, সেতাব রায়দের মাধ্যমে রাজস্ব মাসোহারা প্রাপ্তির পর্ব পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি মূলত ও মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই শাসনকার্য চালিয়েছিল। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল রফতানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এদেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই শাসকের সঙ্গে শাসিতের দায়দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন সামনে আসে এবং ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এ দেশের অর্থনীতি। এ প্রেক্ষাপটেই উৎপাদন, বিপণন ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের যৌক্তিকতা দেখা দেয়, প্রথমে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ অবধি সীমিত অবয়বে আয়কর আদায়ের আয়োজন চলে। মাঝে বন্ধ হয় কার্যক্রম। আবার ১৮৮০-এর পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে চলে। সরকার স্থায়ীভাবে কোনো আইন না করে, স্থানীয়ভাবে এসআরও বা সার্কুলার জারি করে আয়কর আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এসব সার্কুলার ব্রিটিশ আইনের আদলে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রণীত হলেও এদেশীয় করদাতাদের প্রতি তাদের বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকিঝুঁকি দেয়ার প্রবণতা ও প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই সার্কুলারের বাকপ্রতিমায় প্রাধান্য পায়।
করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধিবিধানের ভাষায় এমন একধরনের মনোভাবের প্রকাশ পায় যা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে ওঠে। এ ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে করদাতাদের সলাপরামর্শ দেয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই একটি ব্যবহারজীবী বিজ্ঞ সহায়ক সমাজও গড়ে ওঠে। কিন্তু তাদেরও অগোচরে, কর আইনকে সহজ ও করদাতাবান্ধবকরণে তাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরামর্শ সত্ত্বেও এ দেশে প্রবর্তিত আয়করসংক্রান্ত সার্কুলারগুলোর জটিলতা যুগলবন্দি হয়ে ওঠে সময়ের প্রেক্ষাপটে। ঔপনিবেশিক সরকারের তরফে করদাতাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় না এলেও কর আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদার এবং পাইক পেয়াদাসুলভ যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। উদ্দেশ্য থেকে যায় ‘তোমার আয় হোক আর না হোক অর্থাৎ বাঁচো মরো রাজস্ব আমার চাই’। এ ধরনের আইনি দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে কর আদায়কারী বিভাগের সঙ্গে করদাতাদের সম্পর্ক যুক্তিসংগতভাবে দরকষাকষি বা কিছুটা জবরদস্তিমূলক ও পরস্পরকে এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখী হয়ে পড়ে। অন্তরালে ব্রিটিশ প্রশাসনে বহুল কথিত একটি সাধারণ নির্দেশনা ছিল এ রকম, ‘চোর তো চুরি করিবেই কিন্তু গৃহস্থকে সজাগ থাকিতে হইবেই’। করদাতাদের এরূপ বিরূপ ধারণায় বিবেচনা এবং তাদের ধরার ইন্ধন কর আইনের ভাষ্যে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরূপ পরস্পর অবিশ্বাসের ও প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবেশে কর নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার এবং সে লক্ষ্যে অনৈতিক আঁতাতের মাধ্যম রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতিরও সূত্রপাত ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ততার এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টিতে সেই সময়কার আয়কর আইনের ভাষায় যেন ছিল পরোক্ষ প্রেরণা বা সুযোগ। এমন অনেক আইন আছে, যা বেআইনি আচরণকে উসকে দেয়। এ রকমই পরিবেশে আঁতাতের মাধ্যমে কর ফাঁকি কার্যক্রমে একটা অনভিপ্রেত সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও, এক যুগেরও বেশি সময় সেই ১৯২২ সালের আয়কর আইন ভারত স্থলে পাকিস্তান, পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত ও নামাঙ্কিত হওয়া ছাড়া প্রায় একই মেজাজে বলবৎ ও প্রযোজ্য থাকে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬ নং অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তবে তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে বছর বছর অর্থ আইনে যেসব ছিটেফোটা হিসেবে শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২-এর মূল আইনের ভাব ও ভাষায় দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না। বরং প্রতি বছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার আচার এ কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ, নিষ্কৃতি তথা ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃতি ও সুবিধাসংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে কখনো বা বিভ্রান্ত, কখনো বিকৃত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিস্মৃত। পক্ষান্তরে, যুগধর্মের সঙ্গে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায়সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ, সরলীকরণ তথা করদাতাবান্ধবকরণের পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে আরো জটিল হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে আয়কর ব্যবস্থাকে সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগসংবলিত সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন প্রয়াস বারবার যেন উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের উপরোক্ত পরিচিতি বক্তব্যের বাইরেও নয়া (খসড়া) আয়কর আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য—এটি বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে, ধারা সমুহের মধ্যে রেফারেন্স/প্রভিশন দিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পরিবর্তে বা পরিহার করে ধারা সমুহকে স্বয়ংসম্পুর্ণ, স্বব্যাখ্যাত করার চেষ্টা চলেছে, অডিটের আওতা কমানো, ট্যাক্স রিফান্ডের ব্যবস্থাসহ প্রশাসনিক বেশকিছু সংস্কারের রূপরেখা এখানে রয়েছে। আইনটির প্রয়োগকালকে দীর্ঘমেয়াদি করার কৌশল এবং তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে সাবলীল করতে আধুনিক রীতি পদ্ধতিকে স্বয়ংক্রিয়করণের ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, অনলাইন, ই-কমার্স এসবই আয়কর আইনে স্বীকৃত, অনুসৃত হওয়ার অবকাশ নতুন আইনে থাকার কথা।
বাংলাদেশে কর সংস্কৃতি বিকাশ ব্যাপদেশে করদাতাদের কাছে সেবাধর্মী মনোভাব নিয়ে না গেলে তাদের আস্থায় যেমন আনা যাবে না, তেমনি তাদের স্থায়ী করদাতা হিসেবেও পাওয়া যাবে না। আস্থা সৃষ্টির জন্য কর বিভাগে আপিল শোনার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগীয় সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সফল হওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে করদাতাদের আস্থা সৃষ্টিতে এবং হয়রানি কমাতে কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা হ্রাস একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এজন্য আইনের মধ্যে প্রতিবিধানের ধারণাগত নিশ্চয়তাকল্পে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ উঠে আসবে। উঠে আসবে করের টাকা ব্যয় বণ্টনে স্বচ্ছতার বিষয়টিও।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান