বিশ্বের সব দেশের মতোই বাংলাদেশের অর্থনীতিও কভিডের অভিঘাতে পর্যুদস্ত হয়েছে। তাতে শুধু যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়েছে তা নয়, সেই সাথে কর্মসংস্থান ও নিম্ন আয়গোষ্ঠীর জীবিকার পথও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কভিডের প্রাথমিক পর্যায়ের পর এখন অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে?
শুরুতেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কভিড-পূর্ববর্তী স্বাভাবিক সময়েও এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি শ্লথ ছিল, বিশেষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা অন্যান্য সামাজিক সূচকের তুলনায়। সুতরাং যেকোনো আকস্মিক ধাক্কাতেই শ্রম অধিকারে দুর্বলতা প্রকটতর হতে পারে।
একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অনুরোধ ছিল কর্মস্থানে শ্রমিকের অধিকার কভিডের প্রভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আলোকপাত করার। সেই আলোচনা করতে গিয়েই অনুধাবন করলাম যে শ্রমিকের কর্মনিয়োজনের অধিকার অর্থাৎ কর্মসংস্থান না বাড়লে কর্মক্ষেত্রে অধিকার (Right to work and rights at work) সুপ্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হবে—এই কভিড সময়ে তা হবে দুরূহতর।
এখানে কর্মসংস্থানের ওপর এবং তার প্রতিফলন—বেকারত্বের ওপর কভিড সংক্রমণের প্রভাব ও তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কিছু বিষয় আলোচনা করব।
কভিড সংক্রমণের প্রাথমিক দ্রুত প্রসারের সময়ে সরকারি নির্দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে সাময়িকভাবে বেকারত্ব বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। এ সময়ে কয়েকটি জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকেও এটা দেখা যাচ্ছে। এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং বিআইজিডি ও পিপিআরসি পরিচালিত জরিপে বলা হয় যে দরিদ্র শ্রমজীবীদের মধ্যে এ সময়ে কর্মনিয়োজন হারানোর হার খুব বেশি—৬০-৬৮ শতাংশ।
বিবিএসের এ বিষয়ে একটি সাম্প্রতিক জরিপ মনোযোগের দাবি করে। বিবিএসের জরিপটি সব ধরনের শ্রমশক্তি থেকে চয়নকৃত নমুনা বলেই মনে হচ্ছে (রিপোর্টটি এখনো ওয়েবসাইটে দেয়া হয়নি)। জরিপে দেখা যাচ্ছে যে এপ্রিল-জুলাইয়ে বেকারত্ব হার ছিল ৪৪ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৪.১ শতাংশ।
অন্য জরিপ এবং বিবিএসের জরিপের এ পার্থক্য সম্ভবত এজন্য যে অন্যগুলোতে শুধু দরিদ্র শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত আর বিবিএস সব ধরনের জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে দরিদ্র শ্রেণীই কর্মসংস্থান হারিয়েছে বেশি অনুপাতে।
সেই পর্যায়ে দরিদ্র শ্রেণীর জন্য খাদ্য ও নগদ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে সরকার ও এনজিও, এমনকি ব্যক্তি ও নানা প্রতিষ্ঠান। তারপর সরকার কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যেগুলো মূলত বিভিন্ন ধরনের উদ্যোক্তার জন্য সহজ শর্তে ঋণ। বৃহৎ উদ্যোক্তারা এসব ঋণ ব্যবহার করছেন এবং তার সুফল হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে এ বিষয়ে উৎসাহ কম এবং তাদের জন্য ঘোষিত অর্থের ক্ষুদ্র অংশই ব্যবহূত হয়েছে।
কাজেই এখন প্রশ্ন আগামী সময়গুলোতে এ বছরের শেষ কয় মাস ও আগামী বছর অর্থনীতি কেমন চলবে এবং তার ফলে কর্মসংস্থান ও বেকারত্বের ক্ষেত্রে কী চিত্র দাঁড়াবে। বেকারত্ব হার কি অতি দ্রুত হ্রাস পেয়ে এ বছরের জানুয়ারি-মার্চের পর্যায়ের যাবে?
বিবিএসের জরিপলব্ধ তথ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ছুটি ও বন্ধ সময়ের পর সেপ্টেম্বরে এসেও কিন্তু বেকারত্ব হার মার্চের তুলনায় দ্বিগুণ।
এবার সামগ্রিক চিত্রের সম্ভাব্য দিকগুলো দেখা যাক। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেকারত্ব হার গড়ে যদি ৪-৫ শতাংশে (বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপগুলোতে যে রকম তথ্য ২০১৭-এর জন্য) নেমে আসতে হয় তাহলে আগামী নয় মাসে এটা অনেক দ্রুত হ্রাস পেতে হবে।
অথচ কয়েকটি কারণে এর বিপরীত ধারা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়। বেকার সংখ্যা ও বেকারত্ব হার বৃদ্ধির জন্য দুদিক থেকে কিছু শক্তি কার্যকর থাকবে। একদিকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ও পরিমাণ তত বেশি নাও হতে পারে। অন্যদিকে মোট শ্রমশক্তি, যারা কর্মনিয়োজনের জন্য আসছে, তার সংখ্যা কয়েকটি কারণে বাড়বে এ দুয়ের ব্যবধান অর্থাৎ বেকারত্ব বেড়ে যাবে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ও পরিমাণ কম হওয়ার জন্য দায়ী হবে মূলত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরায়নের এমন কৌশল গ্রহণ যাতে পুঁজিঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এ প্রবণতা দেখা যেতে পারে কারণ আগামী এক-দুই বছর প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান উৎস হতে পারে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুততর বাস্তবায়ন। সেগুলোতে পুঁজিঘনত্ব বেশি। তদুপরি ব্যক্তি খাতেও বৃহৎ উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে সেখানে শ্রমঘনত্ব কম।
এবার আসা যাক শ্রমশক্তির সরবরাহ কেন ২০২১-এ অন্য স্বাভাবিক বছরের তুলনায় বেশি হবে তার পর্যালোচনায়। স্বাভাবিক একটি বছরে এ দেশে গড়ে ১৩-১৪ লাখ নতুন শ্রমশক্তি প্রবেশ করে। আরো ছয়-আট লাখ বা তার বেশি যায় বিদেশে কর্মসংস্থান নিয়ে।
কিন্তু ২০২০ সালে কভিড-পরবর্তী মাসগুলোতে অনেক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেনি চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনা কম, সে কারণে নিরুৎসাহিত হয়ে। ২০২১ সালে তারা ঢুকবে। ২০২০ সালে বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে খুব কম, আড়াই-তিন লাখ। গড়ে যদি আট লাখ অভিবাসী কর্মসংস্থানে গিয়ে থাকে আগের বছরগুলোতে, এ বছর সেখানেও প্রায় পাঁচ লাখ ঘাটতি। আগামী বছরেও বিদেশে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থান খুব বাড়বে, তেমন আশা করা যায় না। সেখানেও একটি ঘাটতি তৈরি হবে। এরা সবাই বা অন্তত একটি বড় অংশ দেশের শ্রম সরবরাহে যুক্ত হবে। কাজেই ২০২১ সালে শ্রমের মোট সরবরাহ হবে ১৩-১৪ লাখের বদলে ২০ লাখের কাছাকাছি বা আরো বেশি। ফলে বেকারের সংখ্যা ও হার আকস্মিক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
আর শ্রমশক্তির সরবরাহ বেশি, চাহিদা তৈরি হচ্ছে কম, ফলে কর্মসংস্থানের মান, মজুরি বা বেতন, কর্মক্ষেত্রে অধিকার সবই নিম্নগামী হতে পারে। কভিড সময়ের কর্মসংস্থানের ঘাটতি পূরণ করতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হবে। ততদিন কর্মনিয়োজনের মানোন্নয়ন দুরূহ হবে। মধ্যমেয়াদেও এ সমস্যা থাকবে, এমনকি প্রকটতর হতে পারে।
আগামী কয়েক বছর আরো একটি সমস্যা বিরাজ করবে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানের মান নির্ভর করে তরুণ চাকরিপ্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর। ১০-১৫ বছর ধরে শিক্ষার্জন ও শ্রমমক্তির মান বাড়ছিল। কিন্তু কভিডের সময়ে প্রায় পুরো বছরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকল। ফলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত পড়াশোনা অর্জনের মাত্রা হ্রাস পাবে। সেটা এমনিতেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রার তুলনায় কম ছিল। অনেক নিম্ন আয় পরিবারের আয় হ্রাস পেয়েছে। তারা সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে কম বিনিয়োগ করবে। এমনিতেই স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তানেরা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। এখন সেই দূরত্ব বাড়বে।
তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং অনেকেই প্রত্যাশার চেয়ে কম বয়সে ও যোগ্যতা নিয়ে শ্রমশক্তিতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। এসব ক্ষেত্রে তরুণদের জন্য ভালো মানের কর্মসংস্থান হবে দুরাশা।
উচ্চশিক্ষায়ও মেধাবী ছাত্ররা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পাঠরত ছিল, তারা অনলাইন কোর্সের সুবিধা তেমন পায়নি। ফলে একটি শিক্ষাবর্ষ বা সেমিস্টার পিছিয়ে যাবে, দুটি শিক্ষাবর্ষের ছাত্রছাত্রী খুব কাছাকাছি সময়ে শিক্ষা সমাপন করে শ্রমবাজারে ঢুকবে—এত কর্মসংস্থান কোথায়! তার পরও শিক্ষক-ছাত্রদের সম্মিলিত চেষ্টায় এসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়। আগের মতো রুটিনমাফিক ক্লাস ও কোর্স সমাপন ছাড়া কিছু উদ্ভাবনীমূলক প্রচেষ্টা নিয়ে এসব মেধাবী তরুণকে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন কর্মকাণ্ডের জন্য উপযোগী করে তুলতে হবে। তাতে তারা শুধু চাকরিপ্রার্থী হিসেবে নয়, উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠবে।
তবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে কর্মসংস্থানের সমস্যাটি প্রকট হওয়ার আগেই বিষয়টি অনুধাবন করে সচেতনভাবে নীতি-কৌশল গ্রহণ করাটা আবশ্যক।
বর্তমান সময়ে অর্থনীতির বিভিন্ন নীতিসূচক, বিশেষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরায়ন, অন্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় মাথাপিছু গড় জিডিপি বৃদ্ধির প্রবণতা, এগুলো অবশ্যই সুসংবাদ। কিন্তু মাথাপিছু গড়ের অন্তরালে যে বিষয়টি লুকিয়ে থাকে তা হচ্ছে যদি কর্মসংস্থান না বাড়ে, কর্মনিয়োজনের মান না বাড়ে, নিম্ন আয়গোষ্ঠীর আয় না বাড়ে, তাহলে সমাজে বৈষম্য আরো অসহনীয় হবে। দারিদ্র্য হ্রাসের যে অর্জন নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে, তা অর্জিত হয়েছিল কর্মসংস্থান ও মজুরি বা বেতনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার ফলে।
কাজেই প্রবৃদ্ধি ত্বরায়নের কৌশলের সাথে সেই গতি যেন কর্মসংস্থান বৃদ্ধিও দ্রুততর করে সেটা দেখতে হবে। এ দুয়ের যোগসূত্রটি আপনা থেকে ঘটবে না। এ বিষয়ে দৃঢ় লক্ষ্যমাত্রা ও কৌশল গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই।
রুশিদান ইসলাম রহমান: অর্থনীতিবিদ, বর্তমানে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডার) এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন