সেই
১৯৬৯ সালের
কথা। সবেমাত্র
স্বপ্নের ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হয়েছি। আমাদের
পরিসংখ্যান বিভাগ
সায়েন্স এনেক্স
ভবনে। শহীদ
মিনারের সন্নিকটে
হওয়ায় ঊনসত্তরের
সেই উত্তাল
দিনগুলোর উত্তাপ
আমরা বিশেষভাবে
অনুভব করতাম।
বিভিন্ন কার্যক্রমে
মাঝে মাঝে
অংশগ্রহণও করেছি।
ক্লাসের ফাঁকে
ফাঁকে বন্ধুরা
মিলে আড্ডা
দিতাম অফিস
সহকারী সুরেশদার
বানানো লেবু
চা বা
বলাইয়ের ক্যান্টিনের
শিঙাড়াসমেত। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে
আমরা খুব
উদ্বেলিত ছিলাম।
‘প্রাচ্যের
অক্সফোর্ড’ বলে
কথা। আমাদের
মধ্যে মাঝে
মাঝে তর্ক
হতো—কোনটি
বেশি খ্যাত,
অক্সফোর্ড না
হার্ভার্ড? আমার
পরিচিতজনের কেউ
কেউ লন্ডন
স্কুল অব
ইকোনমিকসে পড়াশোনা
করেছিলেন, তাই
আমি এলএসইর
কথাও পাড়তাম।
হার্ভার্ড থেকে
পিএইচডিধারী যে
গুটিকয়েক বাঙালির
কথা তখন
শুনতাম তাদের
মধ্যে ছিলেন
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক
নূরুল ইসলাম
ও অধ্যাপক
আনিসুর রহমান।
যা হোক,
এসব কথোপকথনের
মধ্যেই একদিন
আগ্রহভরে শুনেছিলাম
আরেকজনের কথা—হার্ভার্ডে
ডক্টরেট পড়ুয়া
প্রথম বাঙালি
নারী। শুনে
মনটা গর্বে
ভরে গিয়েছিল।
তিনি আর
কেউ নন
এখনকার অধ্যাপক
রওনক জাহান,
আমাদের রওনক
আপা।
আমাদের অনার্স
শেষ হতে
হতেই তিনি
পিএইচডি শেষ
করে দেশে
ফিরে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা
শুরু করেছিলেন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত
পরের কিছুদিন
আবাসিক হলে
না থেকে
আমি আমার
এক নিকটাত্মীয়ের
এলিফ্যান্ট রোডের
বাসায় থাকতাম।
সে সময়
শুনেছিলাম আমাদের
গলির প্রথম
বাসাটিই নাকি
রওনক জাহানের,
তখনকার কাম্পালা
হোটেলের ঠিক
উল্টো দিকে।
অকারণে তখন
তার সঙ্গে
আর দেখা
করতে যাইনি,
এমন পণ্ডিত
লোকের সঙ্গে
কী আলাপ
করব! সৌভাগ্য
যে তার
সঙ্গে ঠিকই
দেখা হয়েছিল
কিন্তু প্রায়
চার দশক
পরে নিউইয়র্ক
নগরীতে।
২০০২ সালে
নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া
ইউনিভার্সিটিতে আমি
ভিজিটিং প্রফেসর
হিসেবে যোগ
দিই। কোথাও
বেশি সময়ের
জন্য গেলে
আমি বাঙালিদের
খুঁজে বেড়াই।
নিউইয়র্কে অনেক
বাঙালির বাস।
তার মধ্যে
আছেন আত্মীয়স্বজন,
বন্ধুবান্ধব ও
পরিচিতজন। কলাম্বিয়া
ইউনিভার্সিটিতে পেলাম
মাত্র কয়েকজনকে।
মেইলম্যান স্কুল
অব পাবলিক
হেলথের হাবিব
আহসান এবং
টিচার্স কলেজের
মাধবী চ্যাটার্জি।
জানতাম রওনক
জাহান আছেন
স্কুল অব
ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড
পাবলিক অ্যাফেয়ার্স
বা সিপাতে
অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর
হিসেবে। লেখলাম
তাকে নিজের
পরিচয় দিয়ে।
তার বড়
বোন শিক্ষাবিদ
রওশন জাহানের
সঙ্গে আমার
‘এডুকেশন
ওয়াচ’ সূত্রে
পরিচয় ছিল,
সে কথাও
লিখে দিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে
উত্তর এল।
বললেন যে
আমাদের মধ্যে
দেখা হওয়া
দরকার যা
উনার অথবা
আমার অফিসে
হতে পারে।
ভাবলাম, প্রথমে
তো আমারই
যাওয়া উচিত।
তাই হলো।
কয়েকদিনের মধ্যেই
গেলাম ম্যানহাটানের
তার ১১৮তম
স্ট্রিটের অফিসে।
অনেক স্নেহভরে
আমাকে স্বাগত
জানালেন। অনেক
গল্প করলেন,
কিছু ব্যক্তিগত
বাকি পেশাগত।
জানালেন কয়েক
বছর আগের
তার আয়োজিত
বাংলাদেশ সম্পর্কিত
এক আন্তর্জাতিক
সম্মেলনের কথা,
যেখানে অমর্ত্য
সেনসহ অনেক
নামিদামি ব্যক্তি
অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি একজন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, তাই
নাগরিক উদ্যোগ
‘এডুকেশন
ওয়াচ’ সম্পর্কেও
বিস্তারিত জানতে
চাইলেন। তাকে
বললাম কলাম্বিয়ায়
আমার গবেষণা
ও অধ্যাপনার
কথা। মেইলম্যান
স্কুল অব
পাবলিক হেলথের
ডিন আমার
সুপারভাইজার এল্যান
রোজেনফিল্ড সম্পর্কে
তার বিশেষ
শ্রদ্ধার কথা
ব্যক্ত করতে
ভুললেন না।
কফি আনানের
মিলেনিয়াম প্রকল্পের
আওতায় জেফরি
স্যাক্সের নেতৃত্বে
যে কয়েকটি
ওয়ার্কিং গ্রুপ
কাজ করছিল
তার একটির
নেতৃত্বে ছিলাম
যৌথভাবে রোজেনফিল্ড
ও আমি।
এমডিজি ৪
ও ৫এ
শিশু স্বাস্থ্য
ও মাতৃস্বাস্থ্য
ক্ষেত্রে যে
অভীষ্ট দেয়া
ছিল তার
অগ্রগতির চুলচেরা
বিশ্লেষণ করাই
ছিল আমাদের
ওয়ার্কিং গ্রুপের
মূল উদ্দেশ্য।
এ প্রকল্পের
সঙ্গে আমার
সংশ্লিষ্টতা শুনে
রওনক আপা
অনেক খুশি
হয়েছিলেন। এরপর
বেশ কয়েকবার
তার সঙ্গে
দেখা হয়েছে।
তিনি আমার
অফিসে এসেছিলেন।
একসময় এই
যোগাযোগ পারিবারিক
পর্যায়ে চলে
আসে। স্ত্রী-কন্যাসহ
আমি তার
ম্যানহাটানের বাসায়
গিয়েছি এবং
তিনিও আমাদের
বাসায় এসেছিলেন।
মনে পড়ে,
তার বাসার
কাছে এক
মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে
তিনি আমাদের
আপ্যায়িত করেছিলেন,
যেখানে যোগ
দিয়েছিলেন প্রাক্তন
অর্থমন্ত্রী মুহিত
সাহেবের স্ত্রীও।
পরবর্তী সময়ে
মা ও
বোনসহ তিনি
আমাদের ধানমন্ডির
বাসায়ও এসেছিলেন।
নিউইয়র্ক থাকতে
রওনক আপার
সঙ্গে বাংলাদেশ
তথা বহির্বিশ্বের
অনেক বিষয়
নিয়ে আলোচনা
হতো। এর
মধ্যে ছিল
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নাগরিক
সমাজের নজরদারি
প্রসঙ্গ। এডুকেশন
ওয়াচের মতো
স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও একটি
‘ওয়াচ’-এর
প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে
আমরা একমত
হই। ২০০৪
সালের অক্টোবরে
নিউইয়র্ক থেকে
ঢাকা ফিরে
এলে এ
বিষয়ে আরো
মনোযোগী হই।
সে বছরের
ডিসেম্বরে এক
সফরে রওনক
আপা ঢাকা
এলে তাকে
নিয়ে ধানমন্ডির
এভিএসসি অফিসে
এক সভার
আয়োজন করি,
যেখানে বাংলাদেশের
জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট অনেকেই
যোগ দেন।
উপস্থিত সবাই
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নাগরিক
সমাজের নজরদারি
বাড়াতে একটি
প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের
ওপর জোর
দেন। আমি
এডুকেশন ওয়াচের
অভিজ্ঞতার কথা
বর্ণনা করি।
এ সভা
থেকেই এডুকেশন
ওয়াচের আদলে
বাংলাদেশ হেলথ
ওয়াচ আত্মপ্রকাশ
করে। ব্র্যাক
বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস
পি গ্রান্ট
স্কুল অব
পাবলিক হেলথে
এর সচিবালয়
স্থাপিত হয়।
বাংলাদেশ হেলথ
ওয়াচের প্রথম
রিপোর্টটিতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে
বিদ্যমান সমতার
(বা অসমতার)
বিষয়টি প্রাধান্য
পায়। ২০০৬
সালের ডিসেম্বরে
এক সংক্ষিপ্ত
সফরে ঢাকা
আসেন অমর্ত্য
সেন। রওনক
আপার সঙ্গে
আলোচনা করে
তার এ
সফরকে পুঁজি
করে রিপোর্টটির
মোড়ক উন্মোচনের
ব্যবস্থা করা
হয়। তখনো
মূল রিপোর্টটির
কাজ বেশ
বাকি ছিল।
রওনক আপা
নিজে বিভিন্ন
অধ্যায়ের ভিত্তিতে
একটি অন্তর্বর্তীকালীন
রিপোর্ট তৈরি
করলেন, যার
মোড়ক উন্মোচিত
হলো অমর্ত্য
সেন, ফজলে
হাসান আবেদ,
রেহমান সোবহান,
জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ
অনেক স্বনামধন্য
ব্যক্তির উপস্থিতিতে।
২০০৬ সাল
থেকে
প্রায়
দুই বছর
অন্তর হেলথ
ওয়াচের একটি
করে রিপোর্ট
তৈরি হয়ে
আসছে। ২০১১
সালের রিপোর্টটির
মূল প্রতিপাদ্য
বিষয় ছিল
সর্বজনীন স্বাস্থ্য
সুরক্ষা বা
ইউনিভার্সেল হেলথ
কভারেজ। সেবারও
এর মোড়ক
উন্মোচনে ছিলেন
অমর্ত্য সেন।
আরো উপস্থিত
ছিলেন বাংলাদেশের
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল
হক, রওনক
আপার বিশিষ্ট
বন্ধু ফোর্ড
ফাউন্ডেশনের একসময়ের
ঢাকার প্রধান
এড্রিয়েন জারমেইন
এবং ওপেন
সোসাইটির জর্জ
সরোজ। সবসময়ের
মতো সেবারও
আমাদের মূল
অনুপ্রেরণাকারী ছিলেন
রওনক আপা।
২০০৯ সাল
থেকে চার
বছর আমি
রকেফেলার ফাউন্ডেশনের
ব্যাংকক অফিসে
তাদের স্বাস্থ্যসম্পর্কিত
জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা
হিসেবে নিয়োজিত
ছিলাম। এ
সময়কার শেষদিকে
একদিন রওনক
আপার একটি
ই-মেইল
পেলাম। লিখেছেন
যে তিনি
এবং তার
স্বামী অধ্যাপক
রেহমান সোবহান
ব্যাংকক এসেছেন
এবং আমার
সঙ্গে সৌজন্য
সাক্ষাৎ করতে
চান। কথামতো
তারা আমার
সুখুম্ভিতের অফিসে
এসে উপস্থিত
হলেন। কিছু
সময় চা-কফি
খেয়ে অনতিদূরে
এক থাই
রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ
করলাম। সেদিন
আমরা অনেক
কিছুই আলাপ
করেছিলাম। তাদের
বলেছিলাম আমার
দেশে ফেরার
পরিকল্পনার কথা।
বলেছিলাম যে
রকেফেলার ফাউন্ডেশনের
প্রেসিডেন্ট চাচ্ছেন
আমি তাদের
প্রধান কার্যালয়
নিউইয়র্কে ব্যবস্থাপনা
পরিচালক হিসেবে
যোগ দিই,
যা আমি
সসম্মানে ফিরিয়ে
দিয়েছি। মনে
হলো আমার
এ সিদ্ধান্ত
তাদের দুজনের
কারোরই মনঃপূত
হয়নি। যখন
বললাম যে
আবেদ ভাই
চাচ্ছেন আমি
ব্র্যাকে ফিরে
গিয়ে তার
স্থলাভিষিক্ত হই
তখন অবশ্য
তারা আমার
দুটো সিদ্ধান্তকেই
স্বাগত জানালেন।
আরো বললেন
যে দেশে
ফিরে যেন
হেলথ ওয়াচের
কাজেও কিছুটা
মনোনিবেশ করি।
বাংলাদেশ হেলথ
ওয়াচ তার
সগর্ব উপস্থিতি
এখনো দীপ্তভারে
জানিয়ে যাচ্ছে
বিভিন্ন কার্যক্রমের
মাধ্যমে, যার
প্রধান পৃষ্ঠপোষক
হচ্ছেন রওনক
জাহান। বাংলাদেশ
হেলথ ওয়াচের
উপদেষ্টামণ্ডলীর সম্মানিত
সভাপতি হিসেবে
তিনি আমাদের
সার্বক্ষণিক পথপ্রদর্শক,
আমাদের গাইড।
রওনক আপাকে
অনেক অনেক
শুভেচ্ছা ও
অভিনন্দন।
ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী: প্রফেসর, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়; কনভেনর, ওয়ার্কিং গ্রুপ, বাংলাদেশ
হেলথ ওয়াচ