বায়োইনফরমেটিকস একটি আন্তঃশাস্ত্রীয় বিজ্ঞান, যা বিশাল ও জটিল বায়োলজিক্যাল (জৈবিক) ডাটাগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি এবং সফটওয়্যার বা টুলস তৈরি করে। এটি বিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে কম্পিউটার বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, গণিত ও ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞানকে ব্যবহার করে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল ডাটা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, কম্পিউটার বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, গণিত ও ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞানকে ব্যবহার করে জৈবিক সমস্যা সমাধানের বিজ্ঞানই হলো বায়োইনফরমেটিকস। বর্তমান সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও সম্পদের সংকটের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে কৃষি খাত টেকসই সমাধানের সন্ধানে অগ্রসর হচ্ছে। বায়োইনফরমেটিকস বিভিন্ন জীবের জীবনরহস্য বা জটিলতাকে বুঝতে সাহায্য করে এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ জিনোমিকসের পরিধির বাইরেও বিস্তৃত, যা টেকসই কৃষি ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অন্যপক্ষে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে একটি প্রযুক্তির সমাহার, যা কম্পিউটারকে বিভিন্ন উন্নত কার্যকলাপ সম্পাদন করতে সক্ষম করে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে—দেখতে সক্ষম হওয়া, কথা বলা এবং লিখিত ভাষা বোঝা ও অনুবাদ করা, তথ্য বিশ্লেষণ করা, সুপারিশ করা এবং আরো অনেক কিছু। গণিতের অ্যালগরিদম এবং জীববিজ্ঞানে জ্ঞান ও তথ্যের বিস্ফোরণ এবং ফিউশনের ফলে কৃষি, শিল্প ও চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলো দ্রুত বিকশিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
জীবনের কোডগুলোর অর্থ জানা এবং জীবপ্রকৌশলে তা সুনিপুণভাবে ব্যবহারে মানবকল্যাণে কীভাবে বায়োইনফরমেটিকস একটি অত্যাবশ্যকীয় হাতিয়ার হয়ে উঠছে এবং বিষয়টি কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা আলোকপাত করাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। অধিকন্তু টেকসই কৃষি এবং মানবস্বাস্থ্যে এবং আত্মকর্মসংস্থানে বায়োইনফরমেটিকস কীভাবে অবদান রাখছে, তা বিশদভাবে এখানে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে।
বায়োইনফরমেটিকস জীববিজ্ঞানের বিশাল তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিচালনা, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও বিতরণের সব দিক নিয়ে কাজ করে থাকে। এতে অন্তর্ভুক্ত তথ্য হলো জিনের সিকুয়েন্স, জিন ও প্রোটিনের কার্যকারিতা/ফাংশন, ফার্মাকোলজিক্যাল কার্যকারিতা, জীববৈচিত্র্য, প্রোটিনে ত্রিমাত্রিক গঠন পূর্বাভাস, প্রোটিন-প্রোটিন মিথস্ক্রিয়া এবং জিনের প্রকাশ। বায়োইনফরমেটিকস গবেষণার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার ও পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেমন নতুন জিন ও ফার্মাসিউটিক্যাল বা নেশাবিরোধী যৌগ আবিষ্কার করা হয়। বায়োইনফরমেটিকস জীবনের কোড এবং জটিলতাগুলো উদ্ঘাটনের একটি শক্তিশালী টুল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বায়োইনফরমেটিকসের মূল স্তরে, জীববৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর গণনা এবং পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত প্রাথমিক তথ্যাবলিকে অর্থবহ অন্তর্দৃষ্টিতে রূপান্তরিত করে। বায়োইনফরমেটিকসের ভিত্তিগুলো বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে, ডাটাবেজ যেমন জিন ব্যাংক এবং ইউনিপ্রোটের মাধ্যমে জীববৈজ্ঞানিক তথ্যের সংরক্ষণ এবং উদ্ধার শুরু করে গণিতের অ্যালগরিদম বায়োইনফরমেটিকসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন সিকুয়েন্স অ্যালাইনমেন্ট, প্রোটিন স্ট্রাকচার পূর্বাভাস এবং কার্যকরী অ্যানোটেশন সম্পাদনে সাহায্য করে। জিনগত কোড ও প্রোটিনের কাঠামো বোঝা জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসার অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিএনএক্রম বিশ্লেষণে, জিন চিহ্নিতকরণে এবং প্রোটিনের কাঠামো ও কার্যক্রমের পূর্বাভাসে বায়োইনফরমেটিকস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে মেশিন লার্নিং ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির আধুনিক টুলসগুলো ব্যবহৃত হয়। বায়োইনফরমেটিকস বিশ্লেষণে বর্তমানে মেশিন লার্নিং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ২০২৪ সালে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিংকে সক্ষম করার মৌলিক অবদানের জন্য বিজ্ঞানী জন জে. হোপফিল্ড ও জিওফ্রে জি হিন্টন যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
এছাড়া প্রোটিন-প্রোটিন মিথস্ক্রিয়া জানতে বায়োইনফরমেটিকস এক শক্তিশালী হাতিয়ার। কম্পিউটেশনাল হাতিয়ার ব্যবহার করে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন নির্ণয় এবং প্রোটিন-প্রোটিন মিথস্ক্রিয়া জানার কৌশল বা প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী ডেভিড বেকার, ডেমিস হাসাবিস ও জন জাম্পার ২০২৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন।
বায়োইনফরমেটিকসের ভিত্তি ও সাধারণ প্রয়োগ জীবের সিস্টেমগুলোর জটিলতা উন্মোচন করে থাকে। জেনেটিক কোডগুলো নিয়ে জটিলতা দূর করা থেকে শল্যচিকিৎসা এবং পার্সোনালাইজড চিকিৎসার অগ্রগতির ক্ষেত্র পর্যন্ত বায়োইনফরমেটিকস একটি অপরিহার্য বিজ্ঞান হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। ডাটা বিশ্লেষণ, মেশিন লার্নিং এবং পূর্বাভাস মডেলিংয়ের মাধ্যমে জেনোমসংক্রান্ত তথ্যবিদ্যা প্রাথমিক (Raw) ডাটাকে কার্যকরী জ্ঞানে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিকস অপরিহার্য। জিন প্রকৌশল ও সিনথেটিক বায়োলজির বড় হাতিয়ার হচ্ছে বায়োইনফরমেটিকস, মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
টেকসই কৃষি এমন একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ খাদ্য, তুলা ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবেশ, প্রতিবেশ, সম্প্রদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য এবং স্থিরতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। এটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা বজায় রাখতে সার্থক সমতার উদ্দেশ্যে কাজ করে। বায়োইনফরমেটিকস উদ্ভিদের বৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং পরিবেশগত অভিঘাতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতি বা হাতিয়ার যখন বিশ্ব কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পরিবেশের জলবায়ুর অভিঘাত বা প্রভাব হ্রাস করছে। বায়োইনফরমেটিকসের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে—ওমিক্স (জিনোমিকস, ট্রান্সক্রিপ্টোমিকস, প্রোটিওমিকস, মেটাবলোমিকস, আয়নোমিকস, ফেনোমিকস) এবং দ্রুত ফসল উন্নয়ন, নিখুঁত কৃষি, রোগ ও কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু সহনশীলতা, মাটির স্বাস্থ্য এবং মাইক্রোবায়োম বিশ্লেষণ ও প্রকৌশল, কৃষিতে মেটাজেনোমিকস, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অণুজীবের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন সংযোজন, ফসল মডেলিং, খাদ্যনিরাপত্তা ও খাদ্যের পুষ্টিগত মান উন্নয়ন।
টেকসই কৃষির প্রেক্ষাপটে বায়োইনফরমেটিকসের পরিবর্তিত ভূদৃশ্য আরো কিছুটা বিস্তৃত পর্যালোচনা করছি।। ফসল উদ্ভিদের জিনোমিক কোড বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পূর্বাভাস ও প্রশমনে, বায়োইনফরমেটিকস গবেষক, নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারীদের জন্য একটি অপরিহার্য সম্পদ হয়ে উঠেছে। এ প্রবন্ধে কৃষির বিস্তৃত ক্ষেত্রে টেকসই অনুশীলন করার উদ্দেশ্যে বায়োইনফরমেটিকসের বহুমুখী প্রয়োগ, সমাধান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ব্যাপারেও বিস্তারিত আলোচনা করা সমীচীন মনে করছি।
ওমিকস প্রযুক্তি ফসল উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করেছে। এসব প্রযুক্তি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশের জটিল অণুজীববিজ্ঞানের প্রক্রিয়া জানা এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ থ্রুপুট প্রযুক্তিগুলো ফসলের সম্পূর্ণ জিনগত এবং অণুজীবগত গঠন সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে, যা জলবায়ুর অভিঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা, ফলন ও পুষ্টি উপাদানের বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে সাহায্য করে। বিকল্প বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রধান জিন চিহ্নিত করে বিজ্ঞানীরা উন্নত বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফসল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। যেমন খরা সহনশীলতা, রোগ প্রতিরোধ এবং পুষ্টিগত মান উন্নয়ন। এ প্রযুক্তি প্রথাগত বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে এবং সঠিক পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দেয়। ওমিকস প্রযুক্তি ও ফসল উন্নয়নের এ সমন্বয় টেকসই কৃষির নতুন একটি যুগের সূচনা ঘটাতে সক্ষম।
নিখুঁত ও টেকসই কৃষির ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিকস একটি বিপ্লব সৃষ্টি করছে, যা ডাটাচালিত অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে কৃষির কার্যক্রম অপ্টিমাইজ করার একটি কাঠামো প্রদান করছে। উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে সেন্সর, স্যাটেলাইট ও ড্রোনের সহযোগিতায় বিশাল ডাটাসেট তৈরি হচ্ছে, যা মাটির অবস্থা ও ফসলের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য ধারণ করে। বায়োইনফরমেটিকস এসব সম্পদ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে এবং কৃষকদের তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। বায়োইনফরমেটিকস রোগ ও কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। জিনোমিক ডাটা ও উন্নত গণনামূলক সরঞ্জামের সাহায্যে গবেষকরা দ্রুত রোগজীবাণু ও পোকামাকড়ের জিনগত পরিচয় চিহ্নিত করতে সক্ষম হচ্ছেন। এটা শুধু রোগ ও পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে ফসলগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে না, বরং রাসায়নিক কীটনাশকের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। জলবায়ুর স্থিতিস্থাপকতা ও অভিযোজন বৃদ্ধিতে বায়োইনফরমেটিকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য এটি গবেষকদের সাহায্য করে। অভিঘাতের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী মলিকুলার মেকানিজমগুলোর বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এমন ফসল উদ্ভিদ বা শস্যের জাত তৈরি করেছেন, যা চরম জলবায়ুগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম। বায়োইনফরমেটিকস মাটির স্বাস্থ্য ও মাইক্রোবায়োম বিশ্লেষণে টেকসই কৃষির জন্য অপরিহার্য।
মেটাজিনোমিকস কৃষি ক্ষেত্রে একটি নতুন বৈপ্লবিক পদ্ধতি। এটি মাটির, গাছের পৃষ্ঠ বা অন্যান্য কৃষি ক্ষেত্র থেকে শ্রমসাধ্য তথ্য ব্যবহার করে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে বসবাসকারী জটিল অণুজীব সম্প্রদায়কে বুঝতে সাহায্য করে। বায়োইনফরমেটিকস ও মেটাজিনোমিকসের সমন্বয় কৃষকদের মাইক্রোবিয়াল বৈচিত্র্যের মাধ্যমে কম রাসায়নিক ব্যবহারে নয়া কৃষি অনুশীলন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করছে।
বিগ ডাটা পরিচালনা প্রযুক্তিতে উন্নতি, বিশেষ করে জিনোমিকস, প্রোটিওমিকস ও মেটাবোলমিকসে জীববিজ্ঞানকে তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বায়োইনফরমেটিকস এ তথ্যগুলো দক্ষতার সঙ্গে সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ভিজুয়ালাইজ করার জন্য উপকরণ ও কৌশল সরবরাহ করে। বিজ্ঞানের একটি উদীয়মান ক্ষেত্র হিসেবে বায়োইনফরমেটিকস জীবনের রহস্যময় কোডগুলো উদ্ঘাটন, এদের প্রয়োগ সম্ভাবনা প্রেডিকশন এবং কৃষি, পরিবেশ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিকাশে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে।
প্রসারমাণ ও দ্রুত বিবর্তনশীল বায়োইনফরমেটিকসের উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ ক্ষেত্রগুলো এখানে আরো কিছুটা বিস্তারিত আলোকপাত করা যেতে পারে। ১. জিনোমিক ও প্রোটিওমিক গবেষণা: জিনগত কোড ও প্রোটিনের কাঠামো বোঝা জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসার অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিএনএ অনুক্রম বিশ্লেষণে, জিন চিহ্নিতকরণে ও প্রোটিনের কাঠামো এবং কার্যক্রমের পূর্বাভাসে বায়োইনফরমেটিকস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২. সঠিক চিকিৎসা: ব্যক্তিগত (Personalized Medicine) ওষুধের কৌশল উন্নয়নে বায়োইনফরমেটিকস অপরিহার্য, যেখানে চিকিৎসা রোগীদের ব্যক্তিগত জিনগত গঠনের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়। জিনগত বৈশিষ্ট্যাবলি বিশ্লেষণ রোগের সংবেদনশীলতা এবং ওষুধের প্রতি প্রতিক্রিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করতে সহায়তা করে। ৩. ওষুধ আবিষ্কার এবং উন্নয়ন: ওষুধ আবিষ্কারের প্রক্রিয়ায় বহু জীববৈজ্ঞানিক, রাসায়নিক ও গণনা প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত। বায়োইনফরমেটিকস সম্ভাব্য ওষুধের লক্ষ্য চিহ্নিত করা, যৌগগুলোর ভার্চুয়াল স্ক্রিনিং করা এবং সম্ভাব্য ওষুধের সম্ভাব্য অপ্টিমাইজ করতে সহায়তা করে। ৪. রোগের যান্ত্রিকতা বোঝা: জীববৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা রোগের জিনগত ও আণবিক ভিত্তি উন্মোচন করতে পারেন। এটি রোগের যান্ত্রিকতা, সম্ভাব্য বায়োমার্কার ও থেরাপিউটিক লক্ষ্য সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে আসতে পারে। ৫. বিবর্তনবিদ্যা: বায়োইনফরমেটিকস টুলগুলো জীবজগতের মধ্যে নানা প্রাণীর বিবর্তনীয় সম্পর্ক অধ্যয়ন করতে ব্যবহৃত হয়, যা বিজ্ঞানীদের তুলনামূলক জিনোমিকস ও ফাইলোজিনেটিকসের মাধ্যমে বিবর্তনীয় প্যাটার্ন এবং প্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে। ৬. পদ্ধতিগত জীববিজ্ঞান: বায়োইনফরমেটিকস পদ্ধতিগত জীববিজ্ঞান পন্থাগুলোকে সহায়তা করে, যা জীববৈজ্ঞানিক সিস্টেমগুলোকে পুরোটাই মনে করে, বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্যকে একত্রিত করে জটিল জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও সংযোগগুলোর মডেল তৈরি করে। ৭. সর্বজনীন স্বাস্থ্য: মহামারী বিজ্ঞান এবং শিশুস্বাস্থ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিকস রোগের বিস্তার ট্র্যাক করতে, প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত করতে এবং জিনোমিক মহামারী অধ্যয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে থাকে। বায়োইনফরমেটিকস ড্রাগ আবিষ্কারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সম্ভাব্য ড্রাগ টার্গেট শনাক্তকরণ, ড্রাগের ইন্টারঅ্যাকশন পূর্বাভাস এবং লিড কম্পাউন্ডগুলোর উন্নতিতে সহায়তা করে। বায়োইনফরমেটিকস দ্বারা সহজতর ফার্মাকোজেনোমিকসের মাধ্যমে পারসোনালাইজড চিকিৎসার পথ সুগম করেছে। ৮. নিখুঁত কৃষি (precision agriculture): নিখুঁত কৃষির ক্ষেত্রে বায়োইনফরমেটিকস একটি বিপ্লব সৃষ্টি করছে, যা ডাটাচালিত ফলাফল ব্যবহার করে কৃষির কার্যক্রম অপ্টিমাইজ করার একটি কাঠামো প্রদান করছে। উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে সেন্সর, স্যাটেলাইট ও ড্রোনের সহযোগিতায় বিশাল ডাটাসেট তৈরি হচ্ছে, যা মাটির অবস্থা ও ফসলের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য ধারণ করে। বায়োইনফরমেটিকসের এ সম্পদ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে এবং কৃষকদের তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। ৯. কোলাবোরেটিভ গবেষণা: বায়োইনফরমেটিকসের আন্তঃবিভাগীয় প্রকৃতি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ায়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও বিশেষজ্ঞতার সংযোজন সম্ভব হয়, যা আরো ব্যাপক ও প্রভাবশালী গবেষণা ফলাফল অর্জনে সহায়ক। ১০. ক্যারিয়ার সুযোগ ও কর্মসংস্থান: পৃথিবীতে বিভিন্ন ডাটাবেজের কলেবর অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছে। নতুন নতুন সফটওয়্যার ও ডাটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জীববিজ্ঞানে নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চাহিদা বাড়ছে। ফলে বায়োইনফরমেটিকস পেশাদারদের চাহিদা শিক্ষা, শিল্প ও স্বাস্থ্যসেবায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গবেষণা, তথ্য বিশ্লেষণ, সফটওয়্যার উন্নয়ন এবং ক্লিনিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনগুলোয় বিভিন্ন নতুন ক্যারিয়ার পথের সুযোগ সৃষ্টি করছে। আমাদের দেশে জীববিজ্ঞানের সব বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে বায়োইনফরমেটিকস কোর্স রাখা আবশ্যক। একইভাবে কম্পিউটার সায়েন্স, গণিত ও পরিসংখ্যানে জীববিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে মৌলিকবিষয়ক কোর্স এবং বায়োইনফরমেটিকস কোর্স অন্তর্ভুক্তীকরণ জরুরি। গবেষণা প্রকল্পগুলোয় আন্তঃশাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞের সম্পৃক্ততা বায়োইনফরমেটিকসের ব্যবহারিক প্রয়োগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বিশ্বে উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, বায়োইনফরমেটিকস কৃষিবিষয়ক নতুন সমস্যাগুলো সমাধানে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে। টেকসই কৃষির লক্ষ্যে এটি সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমন্বয়ে নিরন্তর অগ্রগতি সাধন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলার মাধ্যমে টেকসই কৃষিখাদ্য উৎপাদন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দ্রুত উৎকর্ষের মাধ্যমে মানব ও অন্যান্য জীবের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বায়োইনফরমেটিকস আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। বায়োইনফরমেটিকস ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির বিকাশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিকাশে অবদান রাখছে। ফলে বায়োইনফরমেটিকসের ক্ষেত্রগুলো দিন দিন বহুমাত্রিকতা লাভ করছে। পেশাগত শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিবেচনায় বায়োইনফরমেটিকস আগামী দশকব্যাপী আরো বিকশিত হবে, এটা আশা করা যায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বায়োইনফরমেটিকস বিষয়ে সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা পর্যায়ের প্রোগ্রাম চালু করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে বর্তমানে বিরাজমান বিশাল বেকারত্ব হ্রাস করার জাতীয় প্রকল্প প্রণয়ন করা যেতে পারে।
ড. তোফাজ্জল ইসলাম: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি